‘যেতে নাহি দিব, হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়…’
প্রকৃতির এই নিষ্ঠুর নিয়ম মেনেই ক্যারিয়ারের শেষ ইউরো খেলতে নামছেন অনেক তারকা ফুটবলাররা, পরবর্তী ইউরোতে যাদের শূন্যতা অনুভব করবেন দর্শকরা। আসুন দেখে নেয়া যাক সেসব তারকা ফুটবলারদের যাদের জন্য হতে পারে এটাই শেষ ইউরো।
- ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (পর্তুগাল)
বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এখনো মুড়ি-মুড়কির মতো গোল করে যাচ্ছেন রোনালদো। তবে থেমে যাওয়া বলতেও একটা শব্দ আছে, ৩৬ বছরে পা দেয়া রোনালদোর জন্য এটা শেষ ইউরোই বলা যায়। যদিও পর্তুগাল কোচ ফার্নান্দো সান্তোস তা মানতে নারাজ, দলের সেরা খেলোয়াড়কে তিনি চান আরেকটি ইউরো খেলাতে। ব্যাপারটা নেহায়েত অসম্ভব হলেও নামটা রোনালদো বলেই উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে নাহ।
আলী দাইয়িকে পেছনে ফেলে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলদাতা হবার রেকর্ডটি একান্ত নিজের করে নেবার বাসনা নিয়েই ইউরোতে যাচ্ছেন এই গোলমেশিন। পর্তুগালের জার্সি গায়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা অভিজ্ঞ রোনালদোর সামনে অবশ্য হাতছানি দিচ্ছে আরো দুইটি রেকর্ড। এই ইউরোতে একটি ম্যাচ খেললেই পেছনে ফেলবেন টমাস রসিকির খেলা চার ইউরো টুর্নামেন্টকে, আর ১ গোল করলেই প্লাতিনিকে ছাড়িয়ে হবেন ইউরোর সর্বোচ্চ গোলদাতা। পাশাপাশি টানা পাঁচ ইউরোতে গোল করার একক কৃতিত্বও যাবে রোনালদোর ঝুলিতে।
গতবার পর্তুগাল চ্যাম্পিয়ন হলেও ইনজুরির কারণে ম্যাচটা শেষ করতে পারেননি, এবার নিশ্চয়ই রোনালদো চাইবেন নিজের শেষ ইউরোতে মাঠ থেকেই বিদায় নিতে।
- লুকা মদ্রিচ (ক্রোয়েশিয়া)
ক্রোয়েশিয়ার সোনালি যুগের অন্যতম কান্ডারী এই মিডফিল্ডার মেসি-রোনালদোর রাজত্বের সময়ে একমাত্র ব্যালন ডি’অর জয়ী। সবার প্রিয় ‘লুকিতা’ এবার খেলবেন নিজের শেষ ইউরো। বুড়ো হাড়ে এখনো যে মরচে পড়তে দেননি সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন মাদ্রিদের হয়ে সর্বশেষ মৌসুমেই।
রাশিয়া বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় মদ্রিচ চাইবেন বিশ্বকাপের ফর্ম ইউরোতেও টেনে আনতে। ক্রোয়েশিয়া ঠিক ফেবারিটের কাতারে না পড়লেও দলগত ফুটবল দিয়ে কতটুকু বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে সেটা বুঝা গেছে গত বিশ্বকাপেই। বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সের সাথে পেরে উঠতে না পারলেও মদ্রিচ নিশ্চয়ই চাইবেন ইউরো জিতে নিজের শেষটা রাঙিয়ে দিতে।
- রবার্ট লেওয়ান্ডস্কি
গত কয়েক মৌসুম ধরেই লেওয়ান্ডস্কি আর গোল শব্দ দুটো যেন সমার্থক হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মেসি- রোনালদোকে পার্শ্বচরিত্র বানিয়ে ফেলা লেওয়ার এটাই শেষ ইউরো। সর্বশেস মৌসুমেই বায়ার্নের জার্সিতে ২৯ ম্যাচে করেছেন ৪১ গোল। এত দুর্দান্ত ফর্ম নিয়ে আগে কখনো কেউ ইউরোতে এসেছেন কিনা সেটাই একটা প্রশ্ন বটে।
পোল্যান্ডের অধিনায়কের দায়িত্বটাও তার কাঁধে। পোল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ ও গোলের রেকর্ড লেওয়ান্ডস্কির দখলে। ১১৮ ম্যাচ খেলে করেছেন ৬৬টি গোল। তবে জাতীয় দলে সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেও বড় টুর্নামেন্টে নিজেকে কখনোই মেলে ধরতে পারেননি লেওয়ান্ডস্কি।
তিনটি মেজর টুর্নামেন্ট খেলে তার গোল মোটে দুইটি। নিজের শেষ ইউরো খেলতে যাওয়া ৩৩ বছর বয়সী লেওয়ানডস্কি নিশ্চয়ই চাইবেন নিজের নামের পাশের এই বেমানান পরিসংখ্যান ঝেড়ে ফেলতে।
- ম্যানুয়েল নয়্যার (জার্মানি)
আধুনিক সময়ের সেরা কিপারদের একজন হলেন ম্যানুয়েল নয়্যার। ক্লাব কিংবা জাতীয় দলের হয়ে যেসব ট্রফি জেতা সম্ভব সবই জিতেছেন। কেবল ট্রফি ক্যাবিনেটে নেই ইউরোর মেডেল। ৩৫ এ পা দেওয়া নয়্যার তাই এবার খুব করে চাইবেন ইউরোটা জিতে নিজের ক্যারিয়ারকে পূর্ণতা দিতে।
দলের অধিনায়কের আর্মব্যান্ডটাও তার হাতে। জার্মানির হয়ে ইতোমধ্যেই খেলে ফেলেছেন ৯৮ ম্যাচ। এই ইউরোতেই ১৩তম জার্মান হিসেবে নাম লেখাতে যাচ্ছেন ১০০ ম্যাচ খেলা ক্লাবে। তবে গ্রুপ অব ডেথে পর্তুগাল এবং ফ্রান্সের সাথে একই গ্রুপে থাকায় নয়্যারের কাজটা সহজ হবে না মোটেও। তবে নিজের শেষ ইউরোতে সব উজাড় করে দিলে নয়্যারের বিপক্ষে যে গোল দেয়া অসম্ভব সেটা বোধহয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
- পেপে (পর্তুগাল)
নিজের ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা আগেই পার করে এসেছেন পেপে। তবে ডিফেন্ডিংটা যে ভুলে যাননি সেটা মনে করতে বেশিদূর যেতে হবে নাহ। উচলে জুভেন্টাসের বিপক্ষে পোর্তোর ম্যাচটাই তার সাক্ষী। ৩৮ এ পা দেয়া এই ডিফেন্ডারের এটাই শেষ ইউরো।
তারুণ্যের জয়গান গাওয়া পর্তুগালের ডিফেন্সে এখন হয়তো তিনি প্রথম পছন্দ নন কিন্তু সুযোগ পেলে নিজেকে যে উজাড় করে দেবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। দেশের হয়ে ১৪১ ম্যাচ খেলা পেপে পর্তুগালের হয়ে জিতেছেন ইউরো আর ন্যাশন্স লিগ। তবে শেষবেলায় দীর্ঘদিনের সতীর্থ রোনালদোকে সাথে নিয়ে আরেকটি ট্রফির স্বপ্ন পেপে দেখতেই পারেন।
- জর্জিও কিয়েল্লিনি
ইতালির রক্ষণভাগের মূল ভরসা কিয়েল্লিনি এবারের ইউরোতে ইতালির অধিনায়ক। ইতালির হয়ে ১০৯ ম্যাচ খেলা কিয়েল্লিনির এটাই শেষ টুর্নামেন্ট। নয়্যারের মতোই বিশ্বকাপ ছুঁতে পারলেও এখনো স্পর্শ করা হয়নি ইউরো জয়ের স্বাদ।
কাছাকাছি একবার গিয়েছিলেন কিন্তু স্পেনের সর্বজয়ী সে দলটার কাছে হেরে গিয়ে সেবার স্বপ্নভঙ্গ হয় তার। কিন্তু ইতালির সাম্প্রতিক ফর্ম কথা বলছে তার পক্ষেই, সর্বশেষ ২৮ ম্যাচ অপরাজিত ইতালিকে নিয়ে ইউরো জয়ের স্বপ্ন দেখতেই পারেন কিয়েল্লিনি।
- গোরান পান্ডেভ (মেসিডোনিয়া)
১৭ বছর বয়সে জাতীয় দলে অভিষেকের পর থেকে টানা ২০ বছর যাবত জাতীয় দলের হয়ে খেলে চলেছেন গোরান পান্ডেভ। উত্তর মেসিডোনিয়ার ইতিহাসের সেরা এই ফুটবলার ছিলেন ২০১০ সালের ট্রেবলজয়ী ইন্টার মিলান দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
জর্জিয়ার বিপক্ষে দারুণ এক গোল করে মেসিডোনিয়াকে এনে দিয়েছেন প্রথমবারের মতো ইউরো খার স্বাদ। ৩৭ বছরে পদার্পন করা পান্ডেভের এটাই জাতীয় দলের হয়ে শেষ টুর্নামেন্ট। পান্ডেভ নিশ্চয়ই চাইবেন গোল করে নিজের শেষটা স্বরণীয় করে রাখতে।
- বুরাক ইলমাজ (তুরস্ক)
শেষ মৌসুমে লিলের হয়ে ১৬ গোল করে লিগা ওয়ানে পিএসজির দর্প চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছেন তুরস্কের এই বর্ষীয়ান স্ট্রাইকার। তুরস্কের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এই গোলদাতা এবারের ইউরোতে তুরস্কের গোলের মূল ভরসা। বাছাইপর্বেও তুরস্কের টেনেছেন একাই।
ফ্রান্সের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল কিংবা নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তার করা হ্যাটট্রিকই তুরস্ককে এনে দিয়েছে ইউরোর টিকেট। ৩৫ বছর বয়সী ইলমাজের এটাই শেষ ইউরো। নিজের শেষ ইউরোতে তিনি অবশ্যই চাইবেন দলকে নকআউটে তোলার ক্ষেত্রে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে।
- সার্জিও বুসকেটস (স্পেন)
‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি বাট ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট’
পথ হারানো বার্সায় গত মৌসুমে বাজে খেলা বুস্কেটস এ মৌসুমে ফিরে পেয়েছেন নিজেকে। লুইস এনরিকেও তাই সার্জিও রামোসের অনুপস্থিতিতে অধিনায়কের আর্মব্যান্ডটা তার হাতে তুলে দিতে দুবার ভাবেননি। স্পেনের সোনালি প্রজন্মের শেষ প্রতিনিধি হিসেবে খেলবেন নিজের শষ ইউরো। ক্লাব এবং জাতীয় দলের হয়ে ক্যারিয়ারে সম্ভাব্য সকল ট্রফি জেতা বুসকেটস চাইবেন নিজের ট্রফি কেসে আরেকটি ইউরো মেডেল যোগ করতে।
এছাড়াও গ্যারেথ বেল, লিওনার্দো বনুচ্চি, মারেক হামসিক, টনি ক্রুস, হুগো লরিস, করিম বেনজেমা, ওলিভিয়ের জিরুডদেরও শেষ ইউরো এটি।