হঠাৎ হারানো আমাদের সালাহউদ্দিন

শরীরে জ্বালা ধরানো শীতের রোদ।

ঠিক দুপুর বেলা বলে বিরান মাঠের মতো পড়ে ছিল সার্কিট হাউজ ময়দান। কাকপক্ষীরও দেখা নেই। ভুল বললাম। একটু চোখ বোলাতে দূরের এক নেটে দুই কিশোরের দেখা মিললো। একজন ব্যাট করছে। আরেকজন স্বাভাবিকভাবেই বল ছুঁড়ছে। বোলারটি অফস্পিনার। নেট অনুশীলন দেখতে দেখতে হঠাৎ কানে এলো শব্দ দুটো, ‘গুড টার্ন।’

আহ! কী অপূর্ব কাকতাল!

সার্কিট হাউজ ময়দানের ঠিক উল্টোপাশে একটা বহুতল বাড়ি। এই বাড়ির চার তলায় বাস করতেন বাংলাদেশের সময়ের সেরা অফস্পিনার, খুলনার এক সময়ের সেরা কোচ। তিনিও এমন করে বলতেন, ‘গুড টার্ন’।

এই তো হাবিবুল বাশার কয়েক বছর আগেও বলছিলেন—সবকিছু ঠিক থাকলে বিশ্বের সেরা অফস্পিনারদের সাথে তাঁর নাম উচ্চারিত হতো। হ্যাঁ, প্রয়াত শেখ সালাহউদ্দিনের কথা বলছিলাম আমরা। বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক স্পিনার সালাহউদ্দিন। খুলনায় বিভাগের ক্রিকেটার গড়ার কারিগর সালাউদ্দিন এবং সেই যুগে ইনজামাম, রানাতুঙ্গাদের ঘাতক সেই সালাহউদ্দিন।

সালাউদ্দিন বাংলাদেশের ক্রিকেটর দারুণ রোমাঞ্চকর ক্রিকেটারের নাম।

রূপসা নদীর পাড়ে রাজাপুর গ্রামে জন্ম নেয়া এই অফ স্পিনার বড় হয়ে ওঠেন খুলনায় । নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে শুরু হয় ঢাকার ক্রিকেটে পথচলা। ব্রাদার্স ইউনিয়ন, আবাহনী, মোহামেডানে খেলেছেন চুটিয়ে। এই ব্রাদার্সেই প্রথম সালাউদ্দিনকে সতীর্থ ও রুমমেট হিসেবে পেয়েছিলেন সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল, ‘সালাউদ্দিন ভাই আর আমি তিন বছর প্রায় এক রুমে ছিলাম। দারুণ মজার মানুষ ছিল। আবার আমরা বিভাগীয় দলে, জাতীয় দলেও একসাথে খেলতাম। ফলে আমাদের সম্পর্কটাও ছিল অসাধারণ।’

১৯৯৭ এশিয়া কাপে, কলম্বোতে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক হয়েছিল সালাহউদ্দিনের। স্থায়ী বাসিন্দা হিসাব করলে খুলনা শহরের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। সেই ম্যাচে ইনজামাম উল হক ক্যাচ তুলে দেন সালাউদ্দিনের বলে। পরের ম্যাচে জয়সুরিয়া ও রানাতুঙ্গাকেও আউট করেন।

মজাটা হল সালাউদ্দিনের প্রথম সেই শিকার ইনজামামের ক্যাচটা ধরেছিলেন তখনকার তরুণ হাবিবুল। কাছ থেকে এই স্পিনারের বোলিং দেখা বর্তমান নির্বাচক বলছিলেন, ‘আজকের মতো প্র্যাকটিস ফ্যাসিলিটস, জিম পেলে সালাউদ্দিন ভাই বিশ্বের অন্যতম সেরা টেস্ট স্পিনার হতো। আমি জেনে-বুঝে বলছি। সে ওয়ান অব দ্য বেস্ট ছিল।’

হাবিবুলের এই কথাটাই সে সময় বলেছিলেন সাকলায়েন মুশতাক। সাকলায়েনের মতে সালাহউদ্দিন ছিলেন বাংলাদেশ থেকে উঠে আসা সেরা ফিঙ্গার স্পিনার। এই লোকটির ক্যারিয়ার আরও লম্বা না হওয়াতে বিভিন্ন সময় বিস্ময়ও প্রকাশ করেছেন সাকলায়েন।

নানা কারণেই সালাহউদ্দিন ১৯৯৭ সালেই ওই ছয়টি ওয়ানডে খেলার পর আর কখনো জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাননি। তবে ২০০৬ সাল অবধি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট চুটিয়ে খেলেছেন। আর এরপরই খুলনা বিভাগ, তথা বিসিবি পেয়েছে সালাউদ্দিনের সেরা রূপ— ক্রিকেটার বানানোর কারিগর।

ক্রিকেট বোর্ডের ডেভলপমেন্ট বিভাগে যোগ দিয়ে সালাউদ্দিন সেই থেকে খুলনার উঠতি ক্রিকেটারদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন। তার হাত ধরে জাতীয় দলের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন রুবেল, মুস্তাফিজ বা নুরুল হাসান সোহান। অনুর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজও এসেছেন তাঁর হাত ধরে।

তবে এটাও সালাউদ্দিনের সেরা রূপ নয়।

সেরা রূপের কথা বলছিলেন তাঁর সহধর্মিণী ফারহানা সালাউদ্দিন, ‘প্রায় ছুটির দিনে ওর ভেসপা চড়ে আমরা একটু গ্রামের দিকে কোথাও চলে যেতাম। কোনো মাঠে ছেলেদের খেলা হচ্ছে দেখলে ও থামতো। নেমে ছেলেদের সাথে খেলতো। কাউকে চোখে পড়লে খুলনায় আসতে বলতো। কোথাও কোথাও কথা বলে আসতো। পরে আবার যেতো পুরস্কার দিয়ে আসতো।’

ব্যাপারটা শুধু ছেলেদের জন্য। করতেন, এমন নয়। আজকের বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অন্যতম তারকা সালমা খাতুনের মতো অনেকেও এসেছেন সালাউদ্দিনের হাত ধরে। আর মেয়েদের খেলায় আনতে এক ‘দারুণ কৌশল’ও নিয়েছিলেন তিনি। বলছিলেন ফারহানা, ‘আমাদের মেয়েটাকে ও ক্রিকেটে নিয়ে গেলো। বলতো- নিজের মেয়ে না খেললে অন্য একজন বাবাকে আমি কি করে অনুরাধে করবো?’

সালাহউদ্দিনের এই ক্রিকেটের বাতিওয়ালা হয়ে জ্বলতে থাকাটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যই ছিল এক সোনালী গল্পের মতো। কিন্তু সব গল্প কোথায় যেনো থেমে যায়।

২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর; এক কালো ভোরে থেমে গেলো সব গল্প। হৃদযন্ত্রের অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে হঠাৎই চলে গেলেন ৪৪ বছর বয়সী সালাহউদ্দিন। রয়ে গেলো কেবল তার গল্প আর স্মৃতি। মেয়ে সাদিয়া ও ছেলে সাকিবকে নিয়ে এই কষ্টের জীবন রয়ে গেলো ফারহানার।

সাবেক সতীর্থ, বন্ধ, ছাত্র, বোর্ড কর্মকর্তাদের স্মৃতিতে ভালোমতোই আছেন এই অফ স্পিনার। ফারহানাই বলছিলেন, ‘বোর্ডের সবাই খোঁজ-খবর নেয়। ফারুক ভাই, সুমন ভাই, সুজন ভাই; সবাই খোজ নেন। ছাত্ররাও মনে করে। কেবল খুলনার ক্রীড়াঙ্গনে খোঁজ-খবর নেই। তাতে আমার খুব আফসোসও নেই।’

আফসোস না থাকলেও একটা স্বপ্ন আছে সালাহউদ্দিনের স্ত্রীর । চাওয়াটা খুব বড় নয়, ‘খুলনা স্টেডিয়ামে রানার নামে একটা স্ট্যান্ড আছে। পাশের স্ট্যান্ডটা ফাকা । আমি দাবি করছি না। সবাই যদি মনে করেন, খুলনার বা দেশের ক্রিকেটে ওর অবদান আছে, তাহলে ওর নামে একটা স্ট্যান্ড করে রাখলে ভবিষ্যতের শিশুরা জানবে, কে ছিল লোকটা।’

দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্পিনারের জন্য চাওয়াটা কী খুব বেশি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link