হেলমেট মাথায় কিংবদন্তি

২০০৬ সালের ১৪ অক্টোবর, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে রিডিংয়ের বিপক্ষে ম্যাচের প্রথম মিনিটেই প্রতিপক্ষের মিডফিল্ডার স্টিফেন হান্টের হাঁটুর সাথে ধাক্কা খেয়ে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন চেলসির গোলরক্ষক। আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল যে তার জীবন নিয়েও সংশয় দেখা যায়। পরে অবশ্য অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বিপদ থেকে মুক্তি পান।

এই ইনজুরির কারণে তিন মাস মাঠের বাইরে কাটিয়ে ২০০৭ সালে আবারো ফুটবলে ফিরে আসেন চেলসির গোলরক্ষক। তবে সাবধানতা হিসেবে মাথায় বিশেষ ধরনের হেলমেট পরে খেলতে নামেন তিনি। ক্যারিয়ারের বাকিটা সময় এই হেলমেট পরেই প্রতিটি ম্যাচ খেলেছেন এবং এই হেডগার্ড তার ট্রেডমার্ক হয়ে উঠেছে ৷ রাগবি খেলোয়াড়দের মত মাথায় হেলমেট, গ্লাভস হাতে গোলবার সামলানো – নিশ্চিতভাবেই স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে কিংবদন্তি গোলরক্ষক পিটার চেকের ছবি।

১৯৮২ সালের ২০শে মে চেক প্রজাতন্ত্রের প্লাজেন শহরে জন্মগ্রহণ করেন পিটার চেক। মাত্র সাত বছর বয়সে স্কোডা প্লাজেনের মাধ্যমে ফুটবলে হাতেখড়ি ঘটে তার। পরবর্তীতে এই ক্লাবটিই ভিক্টোরিয়া প্লাজেন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শুরুতে অবশ্য স্ট্রাইকার পজিশনে খেলেই অনেকটা সময় পার করেছেন চেক। পরে নিজের শক্তির জায়গাটা উপলব্ধি করতে পেরে গোলরক্ষক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৯৯ সালে চেক দেশের প্রথম স্তরের ক্লাব চিমেল ব্লাসনির হয়ে পেশাদার ফুটবল শুরু করেন, সেখানে ভালো পারফরম্যান্সের সুবাদে দুই মৌসুম পরই চেক প্রজাতন্ত্রের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব স্পার্তা প্রাগে যোগ দেন। ২০০১ সালে সেই ক্লাবে টানা ৯০৩ মিনিট কোন গোল না হজম করে লিগের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড গড়েন পিটার চেক।

অবশ্য প্রাগে এক মৌসুমের বেশি থাকেননি চেক, আসলে এমন অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর অনেক ইউরোপিয়ান ক্লাবই তাকে দলে নেওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ৫.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ফ্রেঞ্চ ক্লাব রেঁনেতে যোগ দেন তিনি। রেঁনের হয়ে দুই মৌসুমে ৭৮টি ম্যাচ খেলে ২৭টি ক্লিনশিট অর্জন করেন তিনি।

ফ্রেঞ্চ ক্লাব থেকে বিদায় নিয়ে পিটার চেক চলে আসেন ইংল্যান্ডে। যোগ দেন ইংলিশ ক্লাব চেলসি এফ.সি। কিংবদন্তি হয়ে ওঠা শুরু হয় লন্ডনের ক্লাবটিতেই। প্রিমিয়ার লিগে নিজের অভিষেক ম্যাচে শক্তিশালী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে ক্লিনশিট রেখে দারুণভাবে শুরু করেন তিনি।

সব মিলিয়ে নিজের অভিষেক মৌসুমটি দুর্দান্ত ভাবে কাটে চেকের, পুরো মৌসুমে তিনি মাত্র পনেরো বার তাকে পরাস্ত করতে পেরেছিল প্রতিপক্ষ দলের ফুটবলাররা। তার এমন পারফরম্যান্সে ভর করে সেই আসরের লিগ শিরোপাও জিতে নিয়েছিল চেলসি, আর চেক পেয়েছিলেন গোল্ডেন গ্লাভস।

পরের মৌসুমেও এমন ফর্ম ধরে রাখেন চেক, চেলসিও আবার জিতে নেয় লিগ শিরোপা। আর প্রথমবারের মতো ‘চেক ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার’ জিতে নেন তিনি। ২০০৪ সাল থেকে ২০১৫ সাল, এই এগারো বছর চেলসি এফসির গোলবার রক্ষার গুরুদায়িত্ব সামলেছিলেন পিটার চেক।

তবে পিটার চেকের চেলসি অধ্যায়ে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা দুইটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল। প্রথমবার ২০০৭/০৮ মৌসুমে স্বদেশী ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে খেলতে নেমেছিল চেলসি। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে ড্র হলে খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে নিজের কাজটুকু বেশ ভালভাবেই করেন পিটার চেক, তবে সতীর্থদের ভুলে শিরোপার কাছ থেকে ফিরতে হয় চেককে।

কষ্টের পরেই তো আসে স্বস্তি, আসে আনন্দ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল হেরে যাওয়ার চার বছর পর পুনরায় আবারো শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে বায়ার্ন মিউনিখের মুখোমুখি হয় চেলসি। অবশ্য রাউন্ড অফ সিক্সটিনে নাপোলি ও সেমিফাইনালে গার্দিওলার বার্সার বিপক্ষে চেকের অতিমানব হয়ে ওঠাই চেলসির ফাইনালে আসার মূল কারণ ছিল।

বায়ার্নের বিপক্ষেও একটি পেনাল্টি সেভসহ বেশকিছু নিশ্চিত গোল বাঁচিয়ে দিয়ে চেলসি’কে রক্ষা করেন পিটার চেক। শেষ পর্যন্ত আবারো খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে, এবার বায়ার্নের চতুর্থ ও পঞ্চম পেনাল্টি শট ঠেকিয়ে দিয়ে চেলসিকে জয়ের দোরগড়ায় পৌঁছে দেন তিনি। আর শেষ শটে গোল করে বাকি কাজটুকু সেরে ফেলেন দিদিয়ের দ্রগবা।

সব মিলিয়ে দ্য ব্লুজদের হয়ে চারটি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা, একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, চারটি ইংলিশ এফএ কাপ, চারটি সুপার কাপ, তিনটি লিগ কাপ এবং একটি ইউরোপা লিগ জিতেছিলেন। এর বাইরেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে বেশ কয়েকবার জিতেছিলেন মৌসুমের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার এবং গোল্ডেন গ্লাভস।

চেলসির সাথে প্রায় এক যুগের সম্পর্ক ছিন্ন করে ২০১৫ সালে আর্সেনালে যোগ দেন চেক। আর্সেনালে যোগ দেয়াটা অবশ্য চেকের ক্যারিয়ারের শেষের শুরু ছিল। পুরনো ক্লাবের মায়া কাটাতে না পারা, কিংবা বয়সের ভারে ফর্ম হারিয়ে ফেলা – কারণ যা-ই হোক না কেন, আর্সেনালে তার পারফরম্যান্স ‘চেক’-সুলভ ছিল না একেবারেই। দল হিসেবেও আর্সেনাল তখন খুব একটা দাপুটে ছিল না। দলটির হয়ে বলার মত শুধু দুইটি সুপার কাপ এবং একটি এফএ কাপ জিতেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালের শুরুর দিকে নিজের বুট জোড়া তুলে রাখেন পিটার চেক।

জাতীয় দলের হয়ে অবশ্য পিটার চেক কিছু করতে পারেননি, বলা যায় করার সুযোন তিনি পাননি। চেক প্রজাতন্ত্রের মত খর্ব শক্তির ফুটবল দল নিয়ে আসলে কিছু করা যায় না। তবু চেক চেষ্টা করেছেন, ২০০৪ সালের ইউরোতে দারুণ পারফরম্যান্স উপহার দেন তিনি।

তাঁর গ্লাভসের জোরেই চেক প্রজাতন্ত্র সেই আসরের সেমিফাইনালে পৌঁছে যায়। সেই আসরে দারুন খেলতে থাকা গ্রিসের কাছে হেরে সেমিতেই ইউরো অভিযানের পরিসমাপ্তি ঘটে পিটার চেকের। দল ফাইনালে না উঠলেও অসাধারণ পারফরম্যান্সের কারণে তিনি অবশ্য ইউরো-২০০৪ এর অলস্টার টিমে জায়গা করে নেন। দেশের হয়ে চারবার ইউরো এবং একবার বিশ্বকাপ খেলেছিলেন পিটার চেক। এছাড়া সাত বার নির্বাচিত হয়েছিলেন চেক প্রজাতন্ত্রের বর্ষসেরা ফুটবলার হিসেবে।

এই শতাব্দীর সেরা গোলরক্ষক কে, এমন প্রশ্নের উত্তরে জিয়ানলুইজি বুফন আর ইকার ক্যাসিয়াসের নামই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে। কেউ আগ বাড়িয়ে হয়তো ম্যানুয়েল নয়্যারের নামও বলতে পারেন। এদের কারোই শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সংশয় নেই, তবে তাদের সমকক্ষ হওয়া সত্ত্বেও কখনো সেভাবে লাইমলাইটে আসা হয়নি পিটার চেকের।

মিডিয়ার কাছ থেকেও নিজের প্রাপ্ত স্তুতি কখনোই সেভাবে পাওয়া হয়নি তার। অথচ পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে সেরা কয়েকজনের মতই ধারাবাহিক ছিলেন তিনি। হয়তো নিজের জাতীয় দল চেক প্রজাতন্ত্রের নড়বড়ে অবস্থান তাকে পিছিয়ে দিয়েছে অন্যদের চেয়ে। ক্যারিয়ার শেষে তাই কিছুটা অপূর্নতা হয়তো থেকে গিয়েছে এই কিংবদন্তি গোলরক্ষকের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link