১০৩, ১৮৯ ও ১০৪*, ১১৭
ইতিহাসের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা চার ইনিংসে সেঞ্চুরি করেন তিনি। ভাবছেন এমন কি আর!
ফর্মের তুঙ্গে থাকলে যেকোনো ভালো ব্যাটসম্যান হয়তো ছুঁয়ে ফেলতে পারবেন এই রেকর্ড। কিন্তু আপনি অবাক হয়ে যাবেন যখন শুনবেন এই ইনিংসগুলোর মাঝে ব্যবধান ছিল আট বছর! ব্যাটসম্যানটি হলেন অ্যালান মেলভিল; সাবেক প্রোটিয়া দলনেতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের থাবায় ক্যারিয়ারের সেরা আটটি বছর হারিয়ে গেলেও যিনি ফিরে এসেছিলেন বীরদর্পে।
অ্যালান মেলভিলের জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রভিন্সের কার্নাভন নামের ছোট্ট গ্রামে। অসামান্য প্রতিভাধর মেলভিল ছোটবেলাতেই নিজের প্রতিভার জানান দেন। মিডলহাউস স্কুলে পড়ার সময় অ্যালান স্টুয়ার্টের অধীনে নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। স্কুলে পড়াকালীন সময়েই তিনি সুযোগ পেয়ে যান নাটালের প্রাদেশিক দলে।
১৯২৯ সালে ইংল্যান্ডগামী দলে নির্বাচিত হন মেলভিল। কিন্তু মেলভিলের বাবার কথা ছিল আগে পড়ালেখা শেষ করতে হবে। মেলভিল নিজেও ছিলেন তুখোড় মেধাবি, সুযোগ পেয়ে যান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু অক্সফোর্ডে এসেই মেলভিল মারাত্নক দুর্ঘটনার শিকার হন, তার মেরুদন্ডের তিনটি হাড়ে চিড় ধরে। মাসছয়েক বিছানায় থাকার পর মাঠে নেমে প্রথম ম্যাচেই করেন অনবদ্য পারফরমেন্স।
ব্যাট হাতে অপরাজিত ১৩২ রানের পাশাপাশি বল হাতে তুলে নেন আট উইকেট। পরের চার বছর তিনি অক্সফোর্ডের হয়ে কাউন্টিতে খেলেন। কাউন্টিতে নিজের অভিষেক ম্যাচেই কেন্টের বিপক্ষে করেন ৭৮ রান। প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরি মিস হয়ে গেলেও খুব বেশি সময় নেননি নিজের প্রথম সেঞ্চুরি পেতে, পরের ম্যাচেই ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে করেন ১১৮ রান। পুরোটা সময় ফর্মে না থাকলেও নিজের প্রথম মৌসুমে প্রায় ৩৩ গড়ে ৫৯১ রান করেন।
১৯৩১ সালে ডেনিস মুর অসুস্থ হয়ে পড়লে মেলভিল অক্সফোর্ডের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। পরের বছরও দলটির অধিনায়ক ছিলেন তিনি। সেও বছরেরই মে মাসে ফ্রি ফরেস্টারের সাথে খেলায় ব্যাটিংয়ের সময় সতীর্থ ব্যাটসম্যানের সাথে সংঘর্ষে তার কলার বোন ভেঙে যায়। মাঠ ছেড়ে বেরিয়া যাবার সময় তিনি অপরাজিত ছিলেন ১১৩ রানে। কয়েক মাস পরে মাঠে নেমে নিজের প্রথম ম্যাচেই তুলে নেন হ্যাটট্রিকসহ নয় উইকেট। এরপর সাসেক্সে যোগ দিলেও এক মৌসুম পর ফিরে আসেন অক্সফোর্ডে।
১৯৩৩ সালে পুনরায় যোগ দেন সাসেক্সে।পরের দুইবছর তিনি সাসেক্সের অধিনায়কত্ব করেন। ১৯৩৪ সালের অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনের কারণে মিস করেন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। পরের সিজনেই সাসেক্সের হয়ে ৪০এর বেশি গড়ে সংগ্রহ করেন ১,৯০৪রান। ১৯৩৫ মৌসুম শেষে তিনি সাসেক্সের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন। পরের মৌসুমে সাসেক্সের হয়ে অনিয়মিতভাবে খেললেও এও মৌসুমেই করেন ক্যারিয়ারসেরা ১৫২ রান। এরপরই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে আসেন এবং জোহানেসবার্গ স্টক এক্সচেঞ্জে চাকরি নেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ফেরার পর তিনি ওয়ান্ডারার্স ক্রিকেট ক্লাবের অধিনায়ক নির্বাচিত হন এবং প্রথম মৌসুমেই তার দল নাটালের সাথে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৩৮-৩৯ ইংল্যান্ড সফরে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা দলে অধিনায়ক হিসেবে ডাক পান যেটি ছিল কিনা তার অভিষেক সফর জাতীয় দলের হয়ে! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় নেন মেলভিল। যদিও ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তনও অন্যতম কারণ তার ফ্লপ করার।
নিজের প্রথম তিন টেস্টে কেবলমাত্র ৩৮ রান করেন তিনি যদিও এরমাঝে দুটো ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পাননি তিনি। নিজের চতুর্থ টেস্টে এসে হাফ সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। পরের টেস্টের দুই ইনিংসেই করেন যথাক্রমে ৭৮ এবং ১০৩ রান। মেলভিলের ক্যারিয়ার দুর্ভাগ্যময়, যখনি ফর্মে এসেছেন তখনি দুর্ঘটনা কিংবা অসুস্থতা এসে হানা দিয়েছে। ঠিক যে মূহূর্তে তিনি আন্তর্জান্তিক ক্রিকেটে ছড়ি ঘুরানো শুরু করেন ঠিক তখনি বেজে উঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা, স্থবির হয়ে যায় পুরো বিশ্ব।
দক্ষিণ আফ্রিকান সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন মেলভিল। যুদ্ধে গিয়ে পুনরায় নিজের মেরুদণ্ডে আঘাত পান তিনি। ডাক্তাররা ধারণ করেছিলেন তিনি আর কখনো ক্রিকেট খেলতে পারবেন নাহ। প্রায় একবছর তাকে স্টিল জ্যাকেট পরে থাকতে হয়। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে তীব্র মানসিক শক্তির অধিকারী মেলভিল ডাক্তারদের বক্তব্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফিরে আসেন ক্রিকেট ময়দানে।
১৯৪৬-৪৭ মৌসুমে ক্রিকেট প্রায় আট বছর পর খেলতে নামেন তিনি। এত সময় কেটে গেলেও ব্যাটিংয়ে মরচে পড়তে দেননি, নিজের প্রথম ম্যাচেই ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ১৫৩ রান করেন তিনি। ফিটনেসজনিত সমস্যা থাকলেও ১৯৪৭ সালের ইংল্যান্ডগামী প্রোটিয়া দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন তিনি।
ট্রেন্টব্রিজে অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচেই ইংলিশ বোলারদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে করেন ১৮৯ ও ১০৪ রান। লর্ডসে পরের টেস্টের প্রথম ইনিংসে করেন ১১৭ রান। তাতেই টানা চার ইনিংসে সেঞ্চুরি করা প্রথম ব্যাটসম্যানে পরিণত হন তিনি যদিও পরবর্তীতে ক্যারিবীয় লিজেন্ড স্যার এভারটন উইকস টানা পাঁচ সেঞ্চুরি করে সেই রেকর্ড ভেঙে দেন। ফর্ম ধরে রেখেছিলেন পরের টেস্টেও, হেডিংলিতে পরের টেস্টে করেন ৫৯ রান।
অবশেষে ১৯৪৯ সালে কব্জির ইনজুরির কারণে নিউল্যান্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বর্ণালি ক্যারিয়ারের ইতি টানেন অ্যালান মেলভিল। ১১ টেস্টে চার সেঞ্চুরি ও তিন ফিফটিতে ৫২.৫৮ গড়ে ৮৯৪ রান করেন মেলভিন। হয়তো পরিসংখ্যানের বিচারে আহামরি নাহ, কিন্তু তার সাহসিকতা, দৃঢ় সংকল্প এবং ক্রিকেটের প্রতি তার ভালোবাসা তাকে করে তুলেছে অন্যদের চেয়ে আলাদা। ক্রীড়া লিখিয়েদের গুরু নেভিল কার্ডাস তো এমনি বলেননি, ‘পরিসংখ্যান একটা আস্ত গাধা!’