জীবনটা কখনো কখনো নাটকের চেয়েও বেশি নাটকীয়।
হঠাৎ ভাগ্যে কিছু বদল না এলে ফখর জামানকে এই দক্ষিণ আফ্রিকা-পাকিস্তান সিরিজটাও টেলিভিশনে দেখতে হতো। হয়তো পাকিস্তান নৌবাহিনীর কোনো একটা ফ্রিগেটে থাকতেন এখন তিনি। হয়তো আরব সাগর ধরে চলতে চলতে রেডিওতে খবর পেতেন এই সিরিজে পাকিস্তান জিতলো কি না!
কিন্তু ভাগ্য তা হতে দেয়নি। পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে কষ্টকর কয়েকটা মৌসুম কাটানোর পর অবশেষে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। নৌবাহিনীর একজন নাবিক থেকে ফখর জামান হয়ে উঠেছেন পাকিস্তান দলের একজন সৈনিক। তাই কোনো জাহাজে বসে নয়, মাঠেই পাকিস্তান-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের একজন যোদ্ধা হয়ে উঠলেন। না, এ দফা ফখর কোনো ইতিহাস তৈরি করতে পারেননি।
মাত্র ৭ রানের জন্য নিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে ডাবল সেঞ্চুরিটা মিস করেছেন। পাকিস্তানও ম্যাচ জিততে পারেনি। তারপরও ফখর জামান প্রমাণ করেছেন, তিনি ক্রিকেটের নাবিক হতেই এসেছেন।
২০১৭ সালে ওয়ানডে অভিষেকের পর থেকে অন্তত সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ফখর একটা বড় ভরসার নাম হয়ে উঠেছেন। রান তুলছেন আজকাল ৪৮-এর ওপরে গড়ে। ওয়ানডেতে এরই মধ্যে ২১০ রানের ইনিংসও খেলে ফেলেছেন। গতকালও একটুর জন্য মিস করেছেন ডাবল সেঞ্চুরিটা।
অবশ্য ফখরের এই ইনিংস তার বিশাল উপন্যাসের মতো জীবনের ছোট্ট একটা অধ্যায় মাত্র। কৈশোর পার হতে না হতেই মারদান এলাকার কাটলাং থেকে এসে নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ফখর। কিন্তু ভালোবাসাটা ছিলো ক্রিকেটের প্রতি। তাকে যখন পিএনএস কারসাজে পাঠানো হলো আরো ট্রেনিংয়ের জন্য, ফখর দেখা করলেন পাকিস্তান ন্যাভাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমির কোচ নাজিম খানের সাথে।
নাজিম খান তাকে দলে আমন্ত্রণ জানালেন। প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরি করে ফখর নিজের ক্ষমতাটা বুঝিয়ে দিলেন। এরপর নাজিম খানই তাকে বিভিন্ন জায়গায় খেলার সুযোগ করে দিলেন। তিনি খেললেন আন্তঃজেলা অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্ট।
নৌ বাহিনীর সমর্থনে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে খেলা শুরু করে দিলেন। ফখর বলেন, সেই সময়টায় বাহিনী থেকে যে সমর্থন পেয়েছেন, তা ভোলার মতো নয়।
রান মেশিনের মতো রান করে গেছেন ফখর এই সময়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে। পাঁচ বছর লড়াই করার পর ২০১৬-১৭ সালের কায়েদ-ই-আজম ট্রফিতে এসে সাফল্য পেতে শুরু করলেন। সেই সাফল্যের ফলেই ডাক পেলেন পাকিস্তান সুপার লিগে। আর প্রথম পিএসএল মৌসুমেই যে তাণ্ডব দেখালেন, তাতে পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি দলে জায়গা হয়ে গেলো।
জাতীয় দলে নিজেকে স্থিতিশীল করতে খুব একটা সময় নেননি। বিশেষ করে পাকিস্তানকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জেতানোর পথে ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় হয়ে নিজের দামটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের সে সময়ের ব্যাটিং কোচ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার বলছিলেন, নৌবাহিনীতে যে শৃঙ্খলা ও পরিশ্রম করার অভ্যেস ফখর পেয়েছেন, সেটা তাকে এখনও উপকৃত করছে, ‘এটা অবশ্যই ও নৌবাহিনী থেকে পেয়েছে। ও দারুণ ফিট এবং ওর এই ফিটনেস ওকে ডাবল সেঞ্চুরি পেতে সহায়তা করেছে। ও নিজের মানসিক শক্তিটা দেখিয়েছে।’
ফখর নিজেও নৌবাহিনীর সেই সময়টাকে ভোলেন না। তিনি বলেন, ‘আমার এই নিজের কঠোর পরিশ্রম করার ব্যাপারটা বাহিনী থেকে এসেছে। আমি ওখানে শিখেছি যে, কিভাবে সর্বোচ্চটা ঢেলে দিতে হয়।’
ফখরের এই পরিশ্রম করা ও চেষ্টা তাকে একটা জায়গায় নিয়ে এসেছে। এখন তার সামনে সুযোগ পাকিস্তানের বড় বড় নামের সাথে নিজের নাম লেখানোর। তরুন এই খেলোয়াড় সেই সুযোগটা নিশ্চয়ই নেবেন। তিনি নিশ্চয়ই পাকিস্তান দলের নাবিক থেকে চালক হয়ে উঠতে।
ফখর বড় ম্যাচের খেলোয়াড়, আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে যেমন জ্বলে উঠলেন – তেমননি পুরো আসর জুড়ে ব্যর্থ থাকার পর পাকিস্তানের জন্য প্রায় জীবন দিয়ে লড়লেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। এখানেই তিনি আলাদা বাকিদের চেয়ে।