স্ক্যালোনি, দ্য আদার লিওনেল

লড়াইটা ছিল দুই লিওরই। দুজনের সামনেই ছিল পর্বতসম চ্যালেঞ্জ। শেষমেশ জিতেছেন দু’জনই। মেসির নাহয় একটা আন্তর্জাতিক ট্রফি প্রাপ্য ছিল নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের জন্য। কিন্তু লিওনেল স্ক্যালোনি? কোচিং ক্যারিয়ার সাদামাটা বললেও বেশিই বলা হয়। এমন একজনের কোচ হয়ে আসাটা আর পাঁচজন সমর্থকের মতো আমারও ভালো লাগেনি।

দলে প্রিমিয়ার লিগের সেকেন্ড বেস্ট এবং সিরি এ’র অন্যতম সেরা গোলরক্ষক থাকা সত্ত্বেও আরমানির প্রতি তাঁর দুর্বলতাও যথেষ্ট বিরক্তি উদ্রেক করেছিল। পরপর কতগুলো ড্র আর কষ্টার্জিত জয় দেখে হতাশ হয়েছি। স্ক্যালোনি কিন্তু নি:শব্দে তাঁর কাজ করে গেছেন। টুর্নামেন্ট শুরু হবার সময় কেউ খেয়ালও করেনি, এই টিমটা শেষ ১৫ – ১৬ টা ম্যাচের একটাও হারেনি।

আসলে স্ক্যালোনি ভালোই বুঝেছিলেন, ভালো খেলেও হারার চেয়ে খারাপ খেলে জেতা বা নিদেনপক্ষে ড্র করাটা জরুরী। ২০০৬ বিশ্বকাপের কথা আমরা ভুলিনি। হোসে পেক্যারম্যানের আর্জেন্টিনা ছিল সেবার বিশ্বকাপের অন্যতম দাবীদার। অদ্ভুত এক আই সুদিং ফুটবল খেলত সেই টিমটা। কিন্তু তাতেও কী লাভ হয়েছিল?

স্ক্যালোনি জানতেন হেরেও হৃদয় জেতার চেয়ে কাপ জেতাটা অনেক দরকার। কারণ ইতিহাস শুধুই পরিসংখ্যান মনে রাখে। এবারের বিরক্তিকর ফুটবল দেখে সমর্থকরা খুব বেশি আশা না নিয়েই খেলা দেখেছেন। এমনকি ফাইনাল জেতার পরও – ‘লাতিন আমেরিকার ফুটবলের মান পড়ে গেছে’, ‘এই আর্জেন্টিনা ইউরোপের বি গ্রেড টিমের কাছেও হারবে’, ‘বিশ্বকাপে ফার্স্ট রাউন্ডও পেরোতে পারবেনা আর্জেন্টিনা’। এই ধরণের কথাবার্তা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু স্কালোনির তাতে কিছু যায় আসেনা। একটা জাতির আঠাশ বছরের শিরোপা খরা তিনি ঘুঁচাতে পেরেছেন তথাকথিত বোরিং ফুটবল খেলেই।

স্কোয়াড নির্বাচনে প্রতিভার থেকেও গুরুত্ব পেয়েছিল কার্যকারিতা। তাই পাবলো ডায়বালা কিংবা মাউরো ইকার্ডির মতো খেলোয়াড়ের জায়গা হয়নি। মেসি, ডি মারিয়া এবং পাপু গোমেজ – তিনজন ক্রিয়েটিভ বল প্লেয়ার থাকা সত্ত্বেও তিনজনকে কখনোই একসাথে খেলাননি স্ক্যালোনি। এমনকি একসাথে দু’জনকেও খুব বেশি সময় মাঠে দেখা যায়নি। স্ক্যালোনি জানেন উইথ দ্য বলের সাথে সাথে অফ দ্য বল খেলার গুরুত্বও অপরিসীম। তাই ম্যাচের পর ম্যাচ সুযোগ নষ্ট করা সত্ত্বেও স্টার্টিং ইলেভেনে নিকোলাস গঞ্জালেস খেলে গেছেন। মূলত: তাঁর দৌড়াদৌড়ি ও হাই প্রেশিং এর ফলেই মাঠের বাঁদিক দিয়ে বিপক্ষের আক্রমণ সেভাবে তৈরী হয়নি।

আর্জেন্টিনাসুলভ স্কিলড ফুটবলের ঝলক আমরা দেখেছি অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষ বলিভিয়া এবং ইকুয়েডরের বিপক্ষে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নক আউট পর্যায়ে মেসি এবং গোমেজকে একসাথে খেলানোর বিলাসিতা দেখাননি স্কালোনি, কারণ অব দ্য বল এঁরা দুজনেই বেশ ইনঅ্যাকটিভ। বিগত দুই দশক ধরে প্রায় প্রতিটা টুর্নামেন্টেই আর্জেন্তিনার শুরুটা হয়েছে আসর কাঁপিয়ে, প্রতিপক্ষকে গোলের মালা পরিয়ে।

কিন্তু, নক আউটে গিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে হারতে হয়েছে। কারণ যে টিমটা বল পায়ে থাকলে বিপক্ষকে ঘাস ধরিয়ে দিত, পজিশন হারালেই ফুটে উঠত তাদের দৈন্যদশা। বল রিকভার করার মত কেউ থাকতো না। বিগত বিশ বছরে মাসচেরানো আর কিছুটা ক্যামবিয়াসো ছাড়া সেইরকম মানের কোনও স্ন্যাচার আর্জেন্টিনা পায়নি।

দায়িত্ব নেওয়ার পর ধীরে ধীরে তাঁর দর্শন প্লেয়ারদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন স্ক্যালোনি। ৬-৫ গোলে হারার চেয়ে ০-০ ড্র বা ১-০ তে জয় অনেক বেশি প্রত্যাশিত। এ বিষয়ে মরিনহোর সাথে কিছুটা মিল রয়েছে তাঁর। তবু স্কালোনি জানতেন, আপফ্রন্টে শুধুমাত্র মেসির ওপর ভরসা করে শিরোপা জেতা সম্ভব নয়, বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ অনেক ম্যাচেই মেসিকে কিছুটা নিষ্প্রভ দেখায়।

এক্ষেত্রে তাঁর হাতে বিকল্প ছিলেন বিগ ম্যাচ প্লেয়ার অ্যাঞ্জেল দি মারিয়া। কিন্তু মারিয়াকে নিয়ে সমস্যা অন্য জায়গায়। জাতীয় দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের ঠিক আগেই চোট পেয়ে যাওয়াটা যেন অভ্যাসে পরিনত করে ফেলেছেন তিনি। ফাইনালে ফিট ডি মারিয়াকে পাওয়ার জন্য এবার অন্য পন্থা নিলেন কোচ। গড়ে ১৫-২০ মিনিটের বেশি খেলাতেন না মারিয়াকে, তাও প্রয়োজন বুঝে।

ফাইনেলের স্টার্টিং ইলেভেন ছিল প্রত্যাশামতোই। রাইটব্যাকে এতদিন মলিনা ভালো খেলে এলেও আজ নামলেন মন্টিয়েল। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- ফিজিক্যালি স্টংগার ডিফেন্সিভ রাইটব্যাককে দিয়ে নেইমারকে রুখে দেওয়া। প্রত্যাশিত এই চালটাই যে এতটা কাজ করবে তা কে ভেবেছিল? ডানদিকে যেন দানব হয়ে উঠেছিলেন রিভারপ্লেটের এই রাইটব্যাক।  শুধু মন্টিয়েলই নয়, আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার আর মিডফিল্ডাররাও কাট ইন করার ন্যূনতম সুযোগই দেননি নেইমারকে।  পায়ে বল এলেই পালা করে রোবাস্ট ট্যাকেলে যাচ্ছিলেন।

বাধ্য হয়েই জায়গা পরিবর্তন করে মাঝের দিকে সরে এসেছেন নেইমার। কিন্তু লাভ হয়নি। বুড়ো ওটামেন্ডির অভিজ্ঞতা আর ক্রিশ্চিয়ান রোমেরোর সলিডিটি দাঁত ফোটাতে দেয়নি। বুকিং হলেও সমস্যা নেই। স্কালোনি নিয়মিত রিপ্লেস করে যাচ্ছিলেন কার্ড খাওয়া প্লেয়ারদের। কিন্তু ফাউলের বিরাম নেই। উদ্দেশ্য ছিল স্কিলফুলি বেটার টিম ব্রাজিলকে তাদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে না দেওয়া। বিরক্ত ব্রাজিলও এরপর ফাউল করা শুরু করেছে, তাতে অবশ্য স্ক্যালোনির পরিকল্পনাই সফল হয়েছে।

আশঙ্কামতোই মেসিকে আজ চেনা ফর্মের ধারে কাছেও পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাতেও একটা লাভ হয়েছে। মেসি সেন্ট্রালে সরে আসায় বোধহয় কিছুটা হাঁফ ছেড়েই বেঁচেছিলেন রেনান লোদি। সেই সামান্য শৈথিল্যেরই মাশুল গুনতে হয়েছে ব্রাজিলকে। সাত বছর আগে যে মারকানায় সোনালি ট্রফির সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন লিওনেল মেসি, সেই মারকানাতেই আজ যেন তাঁর শাপমুক্তি ঘটল। আর এক লিওনেলের হাত ধরে।

সমর্থকরা এই খেলা দেখে বিশ্বকাপ ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হবেন। বোদ্ধারা নাক কুঁচকোবেন। কিন্তু স্কালোনি জানেন এই টিমের গোলবারের নিচে আছেন একজন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। কনফিডেন্সে টইটুম্বুর, মাইন্ড গেমে দক্ষ, নি:সংকোচে ভরসা করার মতো এক গোলরক্ষক। আছেন ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো। চুড়ান্ত আক্রমণাত্মক আটালান্টার হয়ে খেলেও যিনি এই মরসুমে সিরি এ’র সেরা সেন্টারব্যাক। আজকের ম্যাচেও গ্রাউন্ড ডুয়েলে মাত্র একবারই পরাস্ত হয়েছেন। আছেন রডরিগো ডি পল,  আহামরি কেউ না হলেও যাঁর ডেডিকেশন প্রশ্নাতীত।

এগারোজনের প্রত্যেকে তাদের সেরাটা দিতে পারলে এই আর্জেন্তিনাকে রুখবে কে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link