ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা, এটা ঠিক। তাই বলে, ক্রিকেট সবসময় শান্তশিষ্ট লোকের খেলা নয়।
ক্রিকেট মাঠে মেজাজ হারিয়ে ফেলা, একটু খ্যাপা আচরণ করাটা নতুন কিছু নয়। সেই আদিকাল থেকে এটা ক্রিকেটের একটা অংশ হয়েই আছে। কিছু ক্রিকেটার একটু রগচটা থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক।
আজকে মাঠের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মেজাজ হারিয়ে বসা আগ্রাসী ক্রিকেটারদের নিয়ে একটি একাদশ গঠন করার চেষ্টা করছি।
- বেন স্টোকস (ইংল্যান্ড)
সাম্প্রতিক সময়ে মাঠের পারফরম্যান্সে ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার বেন স্টোকস। ইংল্যান্ডের হয়ে তিন ফরম্যাটেই তিনি এখন নিয়মিত মুখ। এছাড়া আইপিএলে তিনি রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে খেলে আসছে বেশ কয়েক আসর ধরে। তবে আচরণের দিক দিয়ে বেশ কয়েকবার বিতর্কে জড়িয়েছেন এই ইংলিশ অলরাউন্ডার।
কিছু বছর পূর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে প্যাভিলিয়নে যাওয়ার সময় এক ভক্তের সাথেও তিনি বিতর্কে জড়ান। পরবর্তীতে অবশ্য এর জন্য তিনি ক্ষমাও চান। এরপর মারলন স্যামুয়েলসের সাথে অনলাইন বিতর্কেও নিজেকে জড়ান স্টোকস। সবশেষ ভারতের বিপক্ষে টেস্টে মোহাম্মদ সিরাজকে স্লেজিং করতে দেখা যায় স্টোকসকে। পরবর্তীতে বিরাট কোহলি এই পরিস্থিতি সামাল দেন। মাঠের ভিতরে স্টোকসের কাছ থেকে এমন আচরণ অবশ্য নতুন নয়।
- গৌতম গম্ভীর (ভারত)
সাবেক কলকাতা নাইট রাইডার্সের অধিনায়ক গৌতম গম্ভীরকে মাঠের মধ্যে আগ্রাসি আচরণ করতে দেখা গেছে। দুইবার আইপিএল শিরোপাজয়ী এই অধিনায়ক বেশ কয়েকবার মাঠের মধ্যে নিজের মেজাজ ঠিক রাখতে পারেননি। ২০১২ সালে বিরাট কোহলির সাথে আইপিএলে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন গম্ভীর। পরবর্তীতে অবশ্য তার সতীর্থ রজত ভাটিয়া এবং আম্পায়াররা এসে পরিস্থিতি সামলে নেন।
অবসরের পরেও টিভি কমেন্ট্রিতে বিরাট কোহলিকে নিয়ে সমালোচনা করেছেন গম্ভীর৷ তিনি বেশ কয়েকবার বিরাট কোহলিকে নিয়ে বিতর্কিত বিবৃতি দিয়েছেন। এমনকি তিনি এটাও বলেছেন বিরাট কোহলি বেশ সৌভাগ্যবান কারণ এতো সিজন শিরোপা জয় না পেয়েও তাকে ব্যাঙ্গালুরু ধরে রেখেছেন।
- বিরাট কোহলি (ভারত): সহ-অধিনায়ক
বর্তমান সময়ে অন্যতম সেরা ক্রিকেটার বিরাট কোহলি সেটা নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সাথে সাথে ব্যাট হাতে আইপিএলেও তিনি দূর্দান্ত পারফর্ম করছেন। ব্যাট হাতে তিনি যেমন বোলারদের উপর চড়াও হন তেমনি মাঠের মধ্যেও প্রায় সময়ই মেজাজ ধরে রাখতে পারেন না। যার জন্য প্রায় সময়ই ছোটখাটো বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।
বিরাটকে প্রেস কনফারেন্সেও প্রায়শই অনেকটাই রগচটা দেখা যায়। যদিও বছরের বছর তিনি নিজের মধ্যে বেশ পরিবর্তন এনেছেন। তবে কিছু ব্যতিক্রম জিনিস সবসময়ই সমর্থকদের চোখে লাগে। ২০১২ সালে আইপিএলে গম্ভীরের সাথে বাকবিতন্ডার কথা তো ইতিমধ্যেই জেনেছেন৷ তবে এর আগেও তিনি দর্শকদের সামনে মেজাজ হারিয়ে বেশ করেকবার চটেছিলেন! তার আগ্রাসন ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য বা দলের জন্য ইতিবাচক কাজ করলেও তার ভক্ত কিংবা অনুসারীরা এটা পছন্দ করেন না অনেকেই।
- রিকি পন্টিং (অস্ট্রেলিয়া): অধিনায়ক
ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা অধিনায়ক হিসেবে রিকি পন্টিং নিশ্চিতভাবে সবার উপরের দিকেই থাকবেন। তবে মাঠের বিতর্কেও জড়িয়েছেন সাবেক এই বিশ্বকাপ জয়ী অজি অধিনায়ক। মাঠে বেশ কয়েকবার মেজাজ হারিয়েছেন তিনি।
মাঠের বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে পন্টিংকে ‘চিটার’ ডাকও শুনতে হইছে। ২০০ সালে ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে এক বিতর্কিত ক্যাচকে তিনি নিশ্চিত আউট বলেই চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এছাড়া ভারতীয় বেশ কিছু ক্রিকেটারকে নিয়েও তিনি এমন কিছু বিবৃতি দিয়েছেন যা ক্রিকেটের যা বেশ বিতর্কের জন্ম দেয়।
- সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ)
নিদাহাস ট্রফির মঞ্চে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা বিপক্ষে ম্যাচ। সেই সময় আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পছন্দ না হওয়ায় অধিনায়ক সাকিব আল হাসান মাঠ থেকে দলকে রীতিমত তুলে নিতে চেয়েছিলেন। টেস্ট ম্যাচ চলাকালে ওয়াহাব রিয়াজের সাথে তাঁর তর্ক-বিতর্ক তো রীতিমত ইতিহাসে পাতায় চলে গেছে।
এখানেই শেষ নয়, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) কিংবা আন্তর্জাতিক ম্যাচে আউট হয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলতে সাকিবকে প্রায়ই দেখা গেছে। আর সাকিব বাংলাদেশ ক্রিকেটের এমন এক চরিত্র – যিনি সমান ভাবে সমালোচিত এবং আলোচিত।
- কাইরেন পোলার্ড (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
২০১৪ আসরের আইপিএলে স্টার্কের সাথে পোলার্ডের বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে ব্যাট ছুঁড়ে মারার ঘটনা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। ওই ওভারের শুরু থেকেই পোলার্ডের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়ান স্টার্ক। এরপর ওই ওভারের এক বলে স্টার্ক বোলিংয়ের জন্য দৌড় শুরু করলে পোলার্ড বলটি খেলবেন না বলে স্টাম্প ছেড়ে দেন! আর সেই সময়ে স্টার্ক বলটি প্রায় পোলার্ডের গা বরারবরই ছুঁড়ে মারেন, যদিও তিনি সহজাত সাধারণ ডেলিভারির মতোই বলটি করেন। এরপর পোলার্ড মেজাজ হারিয়ে স্টার্কের দিকে লক্ষ্য করে ব্যাট ছুঁড়ে মারেন।
এটা ছাড়াও একবার ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে তিনি ডোয়াইন ব্রাভোর সাথেও তিনি হাতাহাতিতে জড়ান। এছাড়াও বেশ কয়েকবার আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়ে আম্পায়ারের সাথে তর্কাতর্কি করেন।
- ক্রুনাল পান্ডিয়া (ভারত)
ভারতীয় অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়ার বড় ভাই ক্রুনাল পান্ডিয়া প্রায় পাঁচ বছর ধরেই আইপিএলে যুক্ত আছেন মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের সাথে। দীর্ঘদিন দলের সাথে থাকায় তিনি বর্তমানে দলের একজন সিনিয়র ক্রিকেটার।
২০২০ আইপিএলের আগে ক্রুনালের বরোদার সতীর্থ খেলোয়াড় দিপক হুডা অভিযোগ করেন যে তাকে ক্রুনাল হেনস্থা করেছে এবং তার সাথে অকথ্য ভাষায় ব্যবহার করে। এপর হুডা আর ঘরোয়া ক্রিকেটে ওই আসরে খেলেনি এবং কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়ে দৃষ্টি দিতে আবেদন করেছিলেন৷ অবশ্য আইপিএলেও ক্রুনালকে নিজের বোলিংয়ের সময়ে ফিল্ডারদের উপর প্রচন্ড রাগ হতেও দেখা যায়। এমনকি ফিল্ডারদের কোনো দোষ না থাকলেও তিনি ক্ষ্রীপ্ত হন।
সম্প্রতি একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায় ক্রুনাল ময়েসচারাইজার ব্যবহারের পর একাদশে বাইরে থাকা এক খেলোয়াড়ের দিকে সেটি ছুঁড়ে মারেন। এতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়।
- হরভজন সিং (ভারত)
সাবেক এই ভারতীয় স্পিনার আইপিএলে বেশিরভাগ সময়ই চেন্নাই এবং মুম্বাইর হয়ে খেলেছেন। যদিও এবারের আসরে তিনি কলকাতার হয়ে খেলছেন। মাঠে অনেকটাই রগচটা থাকেন তিনি। ২০০৮ সালে আইপিএলে মুম্বাই এবং হায়দ্রাবাদের ম্যাচের পর হরভজন সাবেক ভারতীয় পেসার শ্রীশান্তকে চড় মারেন ম্যাচ শেষে হ্যান্ডশেকের সময়! শ্রীশান্তকে এরপর কাঁদতে দেখা গেলেও পরবর্তীতে পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে যায়।
এরপর কয়েক মৌসুম পরেই মুম্বাইয়ের হয়ে রায়ডুর সাথেও তিনি বেশ রাগ দেখান মাঠেই৷ হরভজনের বলে রায়ডু একটি বাউন্ডারি ঠেকাতে না পারলে মাঠেই তার উপর অনেক রাগ দেখান হরভজন। এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তিনি বেশ কয়েকবার মাঠে মেজাজ হারিয়ে বাক বিতন্ডায় জড়িয়েছেন।
- শেন ওয়ার্ন (অস্ট্রেলিয়া)
ক্রিকেট বিশ্বের সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার হিসেবেই পরিচিত সাবেক অজি গ্রেট শেন ওয়ার্ন। অজিদের হয়ে তার ক্যারিয়ারে বেশ সফলতা লাভ করেছেন তিনি। ২০০৮ আইপিএলের উদ্বোধনী আসরে রাজস্থান রয়্যালসকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি আইপিএল শিরোপা জেতেন।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে বেশ সফল হলেও এই কিংবদন্তি বোলার মাঠে প্রায়ই মেজাজ খুইয়ে বসতেন। ২০০৮ আইপিএলের আসরে সৌরভ গাঙ্গুলি ও তিনি নিজ নিজ দলকে নেতৃত্ব দিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। সেখানে একটি ক্যাচ নিয়ে বাক বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন শেন ওয়ার্ন ও গাঙ্গুলি৷ ক্যাচ আসলেই ধরা হয়েছে কিনা সেটা নিয়ে নিজেরাই বাক বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন, যেখানে শেন ওয়ার্ন বেশ আগ্রাসি মনোভাব দেখান।
এছাড়া বিগ ব্যাশে মারলন স্যামুয়েলসের সাথে তার বাকবিতন্ডার কথা সবাই জেনেছেন। দুইজনই একজন আরেকজনের সাথে অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ করেন৷ এবং তাদের এই রেষারেষিটা বেশ লম্বা সময় ধরেই ছিলো।
- মিশেল স্টার্ক (অস্ট্রেলিয়া)
বর্তমান অজি স্পিডস্টার মিচেল স্টার্ক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাটসম্যানদের জন্য এক প্রকার আতংক। তার ভয়ংকর গতি আর ইয়োর্কার বিষে ২২ গজে ব্যাটসম্যানদের উপর নিজের দাপট দেখান। আইপিএলে ২০১৪ সালে তার সাথে পোলার্ডের হওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যেই আপনারা জেনেছেন। এছাড়াও তিনি প্রতিপক্ষের টেইলএন্ডারদের ব্যাটিংয়ের সময় বল করতে গেলে বেশ স্লেজিং করে থাকেন।
তার সাথে ২০১৫ বিশ্বকাপে পাকিস্তানি পেসার ওয়াহাব রিয়াজের ঘটনা সবার জানার কথা। ওয়াহাব রিয়াজের ব্যাটিংয়ের সময় স্টার্ক বোলিংয়ে এসে তাকে স্লেজিং করে। বাউন্সার দিয়ে তাকে পরাস্থ করার চেষ্টা করে। জবাবে বোলিংয়ে এসে শেন ওয়াটসনকে গতি আর একের পর এক বাউন্সারে নাকানিচুবানি খাইয়েছিলেন ওয়াহাব! প্রায় সময়ই প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানের উইকেট নিলে মুখে কিছু শব্দ বলতে দেখা যায় স্টার্ককে। মাঠের মধ্যে সবসময়ই তাকে আগ্রাসি একটা মনোভাব পোষণ করতে দেখা যায়।
- শোয়েব আক্তার (পাকিস্তান)
এই তালিকার একাদশতম ব্যক্তি হলেন শোয়েব আক্তার। ২০০৮ সালে উদ্বোধনী আসরে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে আইপিএলে খেলছেন পাকিস্তানি পেসার শোয়েব আক্তার। মাঠের আচরণে তিনি সবসময়ই আগ্রাসি ছিলেন। বিভিন্ন কারণে তাকে বেশ কয়েকবার ক্রিকেট থেকে নির্বাসনেও যেতে হয়।
এছাড়া এশিয়া কাপে হরভজন সিংয়ের সাথেও একবার মাঠে ঝামেলায় জড়ান তিনি। অবসরের পর এখনো তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্রিকেটারদের নিয়ে নিজের ভিডিওতে বেশ সমালোচনা করেন। মাঠের আচরণের জন্য তাকে বেশ কয়েকবার জরিমানাও গুনতে হয়েছিলো।
- দ্বাদশ ব্যক্তি: মারলন স্যামুয়েলস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
ক্যারিবিয়ানরা সাধারণত মাঠে বেশ উৎফুল্ল থাকে, হাসি-ঠাট্রা করতেই বেশি পছন্দ করে। ক্রিকেট মাঠে আনন্দ দেওয়ার জন্য তারা বেশ জনপ্রিয়। তবে এসবের বাইরে বেশ কিছু ক্রিকেটার মাঠে এবং মাঠের বাইরে বেশ কিছু বিতর্কে জড়িয়েছেন। এর মধ্যে মারলন স্যামুয়েলস আছেন এই তালিকায়। বিগ ব্যাশে শেন ওয়ার্নের সাথে তার বাক বিতন্ডার কথা প্রায় সবার নিশ্চই মনে আছে। বেন স্টোকসের সাথে তার বিতর্কের কথা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৬ বিশ্বকাপে প্রেস কনফারেন্সে টেবিলের উপর পা তুলে অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ করেছিলেন তিনি।
স্টোকসের সাথে তার বাক বিতন্ডা যেনো থামছেই না! সবশেষ ২০২০ আইপিএলে স্টোকস বলেছিলেন সে চায় না কারো ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকা লাগুক, এমনকি তার সবচেয়ে বড় শত্রু মারলন স্যামুয়েলসেরও না! জবাবে স্যামুয়েলস খুব বাজেভাবে আক্রমণ করে স্টোকসকে। এমনকি স্টোকসের স্ত্রীকেও বাজে ভাবে কথায় আক্রমণ করেন।