গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। টুকটুক দিয়ে পাহাড়ি ঢাল দিয়ে নেমে গেলেই প্রকৃতি অভ্যর্থনা জানাবে। এই গ্রামের নাম কুন্দাসালে, এটা স্বয়ং মুত্তিয়া মুরালিধরণের গ্রাম। এখান থেকেই ক্রিকেটার হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক মুরালি।
এখানেই তাঁদের বাড়ি, এখানেই পৈত্রিক ব্যবসা। যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে – ওই যে, ওটাই মুরালিদের বাড়ি। যদিও, মুরালিদের বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশের অনুমতি মেলে না। মুরালি এখানে এখন আর থাকেন না, তিনি থাকেন কলম্বোতে। তবে তাঁর পরিজনরা লাইমলাইট থেকে দূরে একটু ‘প্রাইভেট’ থাকতেই পছন্দ করেন।
যদিও, তাঁদের পারিবারিক ফ্যাক্টরির ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেল। লাকিল্যান্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরি গড়ে তুলেছিলেন মুরালির চাচা এস রামাসামি ও বাবা মুত্তিয়া সিন্নাস্বামী। সময়টা ১৯৬৪ সাল। প্রথমে এই দুজনেই ছিলেন, ছোট্ট এক বেকারির মতো শুরু হয়েছিল সব।
সেলস রিপ্রেজেন্টিভের কাজ করতেন রামাসামি, কিন্তু ভাইকে নিয়ে নিজের কিছু বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বপ্নটি মিথ্যে হয়নি। এখন সেই ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন দুই শতাধিক শ্রমিক, আছেন ৬০ জন সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ, আর বিস্কুট রপ্তানি হচ্ছে আফ্রিকা থেকে ইউরোপ পর্যন্ত।
তবে এই পথ ফুলশয্যা ছিল না। ১৯৭৭ সালে, দেশজুড়ে নির্বাচনের পর ছড়িয়ে পড়া দাঙ্গায় তামিলবিরোধী সহিংসতায় একদল ক্রুদ্ধ জনতা আক্রমণ করে বসে ফ্যাক্টরির উপর, পুড়ে যায় কারখানার একাংশ।
তবে হেরে যায়নি মুরালিধরনের পরিবার। এক মাসের মধ্যেই আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল লাকিল্যান্ড। যদি এই শিল্প টিকেই না থাকত, হয়তো মুত্তিয়া তাঁর ছেলেকে ক্যান্ডির সেই বিখ্যাত সেন্ট অ্যান্থনিস কলেজে পড়াতে পারতেন না। হয়তো মুরালিধরনের হাতে স্পিনের বল উঠতোই না। হয়তো ক্রিকেটের ইতিহাস অন্যরকম হতো।
আজ ফ্যাক্টরিতে জাতপাতের ভেদ নেই। তামিল-সিংহলিজ মিলে চলছে কাজ। যেভাবে জাতীয় দলে অনেক সময় একমাত্র তামিল হয়ে মুরালিধরন হয়ে উঠেছিলেন সহাবস্থান আর সহনশীলতার প্রতীক।
এখনো পরিবারই চালায় এই ফ্যাক্টরি। বাবা মুত্তিয়া ফ্যাক্টরিতে বসতেন ক’দিন আগেও সাধারণ পোশাকে, কোনো ধরণের তারকাসুলভ জাঁকজমক ছাড়াই। যদিও, তাঁর বয়স এখন ৮০’র ওপর। বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় কাটান।
ছোটবেলায় আগুনের সময় মুরালিধরনের বয়স ছিল মাত্র পাঁচ। তখন তারা ব্যস্ত ছিল খেলা নিয়ে, দাঙ্গা নিয়ে নয়। লাকিল্যান্ড ফ্যাক্টরি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে পাল্লেকেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম।
কিন্তু অনেকেই একে চেনেন ‘মুরালিধরন স্টেডিয়াম’ নামে। তাঁর অর্জনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এই স্টেডিয়াম, এটা শুধু কংক্রিট আর লোহার নয়, সেটা এক জীবনের প্রতিচ্ছবি।
বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর খেলার মাঠ যদি কোথাও থাকে, তবে সেটি হয়তো এখানেই। নইলে সেটা বোধহয় স্বর্গ। কে জানে, সেদিন লাকিল্যান্ড আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলে হয়তো এই স্টেডিয়াম কখনওই আলোর মুখ দেখতো না।