যত্রতত্র ব্যবহারে ইদানিং ‘গ্রেট’ শব্দটির ‘গ্রেটনেস’ হারিয়ে যাওয়ার দশা। তেমনি ‘আন্ডাররেটেড’ শব্দটি অতি ব্যবহারে হয়ে উঠেছে ‘ওভাররেটেড’। যখন-তখন যাকে-তাকে ‘আন্ডাররেটেড’ বলে দিয়ে ‘হাইলি রেট’ করার চেষ্টা চলে। তবে, এই ছবির এই লোকটিকে আপাতত সত্যিকার অর্থেই আন্ডাররেটেড বলে মনে হয় আমার।
অনেকে হয়তো জানেনই না, খেয়াল করেননি, বেশ কিছুদিন ধরেই টি-টোয়েন্টি র্যাংকিংয়ের এক নম্বর বোলার তিনি। গত মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ষসেরা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারের পুরস্কারও পেয়েছেন।
তার বোলিংয়ের চেয়ে বরং উদযাপন নিয়েই মনে হয় বেশি আলোচনা হয়। উইকেট নেওয়ার পর কখনও জুতো খুলে ফোন বানিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে ডায়াল করে কাল্পনিক কথোপকথন, কখনও বাস ড্রাইভার, কখনও মর্টাল কমব্যাট, কখনও লাঠিতে ভর করে খুঁড়িয়ে চলা, কখনও আবার পকেট থেকে এক টুকরো কাপড় বের করে চোখের পলকে জাদুদণ্ড বানিয়ে ফেলা – ম্যাজিক!
ম্যাজিক দেখিয়ে উইকেট উদযাপন ক্রিকেট ইতিহাসে আর কেউ করেছে বলে মনে হয় না। তবে শুধু উদযাপনের নয়, এখন তিনি বল হাতেও নিয়মিত ম্যাজিক দেখাচ্ছে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে গতকাল শেষ হওয়া টি-টোয়েন্টি সিরিজে তিনি ম্যান অব দ্য সিরিজ। ৫ ম্যাচে তার শিকার ৭ উইকেট। সিরিজে তার চেয়ে বেশি উইকেট আছে ওবেড ম্যাককয়, ডোয়াইন ব্রাভোর। তার পরও তিনিই সিরিজ সেরা, কারণ ৫ ম্যাচে ২০ ওভার বোলিং করে রান দিয়েছেন মাত্র ৮০!
৫ ম্যাচের সিরিজে ওভারপ্রতি ৪ করে রান, যে কোনো প্রেক্ষাপটে, যে কোনো মানদণ্ডে অসাধারণ। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই বিস্ফোরক ব্যাটিং লাইন আপের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য।
এই সিরিজের আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা দুই সিরিজে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজেও দারুণ বোলিং করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় উঠেছেন এক নম্বরে।
চায়নাম্যান বোলারদের জন্য কন্ট্রোল ও ধারাবাহিকতা সবসময়ই বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি ব্যতিক্রম, এই দুটিই তার দারুণ। সঙ্গে কার্যকর গুগলি, স্লাইডার, ফ্লাইট আর গতির বৈচিত্র, ক্রিজের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার মিলিয়ে তিনি দুর্দান্ত।
অথচ স্কুলের দিনগুলিতে তিনি ছিলেন ফাস্ট বোলার। মানে, তিনি নিজে সেরকমই মনে করতেন! অনূর্ধ্ব-১৪ দলের এক ট্রায়ালে কোচরা বললেন, ‘তোমার বলে তো গতিই নেই। কাটার হয় টুকটাক, তুমি বরং স্পিনার হও।’
তার হৃদয় ভেঙে গেল। তিনি যে চেয়েছিলেন ডোনাল্ড-পোলকদের মতো হতে!
কী করা করা। স্পিনেই মন ঘোরালেন। এক কোচ পরামর্শ দিলেন অর্থোডক্স স্পিনার হতে, কারণ এটা সহজ। আরেক কোচ বললেন রিস্ট স্পিনার হতে। সহজ কাজ তিনি কেন করবেন! জেদ থেকে ‘কঠিন’ রিস্ট স্পিনই বেছে নিলেন।
স্পিনার হলেও নিজেকে খুব বেশি বদলাননি। রান আপ স্রেফ একটু ছোট করলেন। এখনও তাই তার রান আপ স্পিনার হিসেবে বেশ লম্বা। টেকনিক্যালি নিখুঁত হওয়ার চেষ্টাও খুব একটা করলেন না। সহজাতভাবে যেটুকু আসে, নিজেকে ততটুকুই ভেঙে গড়ার চেষ্টা করলেন।
স্পিনার হিসেবে গড়ে ওঠার দিনগুলিতে তার গুরু হয়ে গেলেন ব্র্যাড হগ। না, সরাসরি নয়। চায়নাম্যান বোলার বলতে আন্তর্জাতিক আঙিনায় তখন কেবল হগই! প্রচুর ভিডিও দেখতে থাকলেন হগের। আর রিস্ট স্পিনার যখন, শেন ওয়ার্নের বোলিং দেখা তো অবশ্য কর্তব্য।
দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো-মন্দ মিশিয়ে চলতে থাকল তার পারফরম্যান্স। প্রথমবার নিজের দুনিয়া বড় করার সুযোগ পেলেন তিনি ২০১৫ সালে। সিপিএলে সেবার সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের কোচ এরিক সাইমন্স, দক্ষিণ আফ্রিকার সুপরিচিত কোচ। তিনিই সিপিএলে নিয়ে গেলেন তাকে। মারলন স্যামুয়েলসেরও ভূমিকা ছিল। আগের বছর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে একটি প্রস্তুতি ম্যাচে তাকে দেখে মনে ধরেছিল স্যামুয়েলসের। ওই সুযোগের পর কেবলই এগিয়ে চলা।
পরের বছর আইপিএলে স্যামুয়েল বদ্রির বদলি হিসেবে সুযোগ মিলল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুতে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার আগেই বিদেশি দুটি লিগের স্বাদ পাওয়া হয়ে গেল।
সময়ে জাতীয় দলের ডাকও এলো। তবে জায়গা পাঁকা করাই কঠিন। ওয়ানডেতে খেলছেন ইমরান তাহির, টেস্টে কেশব মহারাজ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট দুর্দান্ত রেকর্ডের পরও ( এখন ৩৩৪ উইকেট) দুটির বেশি টেস্টে সুযোগ মেলেনি মহারাজের কারণেই। ক্রমে টি-টোয়েন্টিই হয়ে গেল তার ভুবন। এখন সেখানে তিনিই রাজা।
তিনি আর জর্জ লিন্ডা মিলে টি-টেয়োন্টিতে দক্ষিণ আফ্রিকার স্পিন আক্রমণ এখন দারুণ কার্যকর। হ্যাঁ, শুনতে অদ্ভূত শোনালেও সত্যি। দক্ষিণ আফ্রিকার টি-টোয়েন্টি স্পিন আক্রমণ বেশ ভালো! পরীক্ষা যদিও বেশ বাকি তাদের।
উদযাপনে যে ম্যাজিক দেখিয়ে তিনি হইচই ফেলে দিয়েছিলেন, সেটি কিন্তু হুট করেই নয়। একসময় তিনি ম্যাজিশিয়ানই হতে চেয়েছিলেন, নিয়মিত অনুশীলন করতেন। পরে ক্রিকেটে বয়সভিত্তিক দলগুলিতে সুযোগ পাওয়ার পর জাদুকর হওয়ার স্বপ্ন পাশে সরিয়ে রাখেন।
তবে সেই জাদুকর সত্ত্বা জেগে ওঠে প্রায়ই। তাবরাইজ শামসি এখনও জাদুই দেখান। কখনও বোলিংয়ে, কখনও উদযাপনে।
– ফেসবুক থেকে