সন্ধ্যারাতের কবি
মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দেখলে আবার আধুনিক রাখালের কথা মনে পড়ে। হঠাৎ বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হয়তো। বা ট্রাক্টর নিয়ে একাই নেমে পড়লেন ক্ষেতে।কিংবা অরণ্যদেব। সব হিসেবের বাইরে। নিজের হিসেব মতো হাজির হন হঠাৎ। সবাইকে চমকে নিজের মতো হারিয়ে যান। বাড়ির লোকেরাই বা কি পায়? শুনেছি, মেয়ে জিভা হওয়ার খবরটা সাক্ষী দিয়েছিলেন সুরেশ রায়নাকে। ধোনিকে বলে দেওয়ার জন্য। ধোনি তখন অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে দলের সঙ্গে।
মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দেখলে কখনও এক কবির মতো মনে হয়। হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যান কখন। বাড়ির লোকেরা ছাড়া সে সময় কেউ পায় না। কিংবা রোবট। ভিতরে লুকিয়ে রাখতে পারেন সব অনুভূতি। আগ্রাসন, ক্ষত, টেনশন, উচ্ছ্বাস, যন্ত্রণা।
মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দেখলে আবার আধুনিক রাখালের কথা মনে পড়ে। হঠাৎ বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হয়তো। বা ট্রাক্টর নিয়ে একাই নেমে পড়লেন ক্ষেতে।
কিংবা অরণ্যদেব। সব হিসেবের বাইরে। নিজের হিসেব মতো হাজির হন হঠাৎ। সবাইকে চমকে নিজের মতো হারিয়ে যান। বাড়ির লোকেরাই বা কি পায়? শুনেছি, মেয়ে জিভা হওয়ার খবরটা সাক্ষী দিয়েছিলেন সুরেশ রায়নাকে। ধোনিকে বলে দেওয়ার জন্য। ধোনি তখন অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে দলের সঙ্গে।
মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দেখলে এক এক সময় এক উদাসীন বালকের মতো মনে হয়। নিজের শর্তেই বাঁচার কথা শুনি যখন। মোবাইল রাখেন না। নিজের ইচ্ছেমতো লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। বা রাখেন না। তাঁকে সবাই ইচ্ছেমতো পায় না। মনে হলে টিমবাসের ড্রাইভারকে সরিয়ে চালক হয়ে যেতে পারেন দ্বিধাহীন। কাউকে আগে না জানিয়ে নিজেই জানিয়ে দিতে পারেন অবসরের কথা। তিনবার তিনি অবসর নিলেন। কাউকে আগে থেকে বুঝতে না দিয়ে।
এই একই লোক হঠাৎ আবার প্রকাশ্যে এলে আবার রাখাল থেকে আধুনিক হয়ে এক নয়া স্টাইল স্টেটমেন্ট ঝুলিয়ে নেবেন। চুলে বা দাড়িতে। এই যেমন আইপিএলের প্রথম ম্যাচে দেখলাম তাঁর দাড়ি এবং বাইসেপস নিয়ে আলোচনা। এই দাড়িটা নাকি ‘বালবো’ আর ‘মার্টিন চপ’ স্টাইলের ফিউশন। হলিউডের হিউজ জ্যাকম্যান উলভারাইন আর রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের গোটি লুকসের অবতার।
রাঁচির রাখাল মুহূর্তে পৌঁছে যেতে পারেন হলিউডি নায়কের সঙ্গে তুলনায়। শনিসন্ধ্যায় ৪৩৬ দিন পরে মাঠে নামার পর দাড়িটা বাদে আর তো কিছুই বদল দেখা গেল না। সব এক রকম। গত ১২ বছর ধরে ( চেন্নাইয়ের সাসপেনশনের বছর বাদ দিলে) সন্ধ্যা মানে ওই হলুদ রং মানে ধোনির নির্লিপ্ত শান্ত ক্ষিপ্রতা আমাদের অনুভবের সঙ্গী হয়ে থেকেছে নিরন্তর। সন্ধ্যারাতের জয়ধ্বনি হয়ে। নীল রংয়ে আর দেখব না তো কী, হলুদই সই।
দেখলাম, টস জেতার সময় সেই সহাস্য রসিকতা, ‘আম্পায়ারকে প্রশ্ন করতে হবে, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং নিয়ম মানলে ফার্স্ট স্লিপ রাখা যাবে তো?’ উত্তেজনার মধ্যে শেষ ওভারে জিতেও অসম্ভব শান্ত। গতবারের ফাইনালের বদলা? ফ্যানরা বলতে পারে, তিনি নন।
টেক্সট বুক থেকে তুলে আনা ক্যাপ্টেন্সি। প্রতিপক্ষ ৪ ওভারে ৪৬ তুলে ফেলেছে দেখেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে ঠিক সময়ে পীযূষ চাওলাকে আনা। ব্যাটিং অর্ডারে হঠাৎ ২২ বছরের ইংরেজ তরুণ কারানকে নিজের এবং কেদারের আগে তুলে পাঠিয়ে দেওয়ার ‘আউট অফ বক্স’ আইডিয়া।
শেষ দিকে কেদার যাদবকে না নামিয়ে নিজে নামতে পারার মতো কলিজা। এক বছরের বেশি ম্যাচ ফিটনেস ছাড়া এ ভাবে দুটো চমৎকার ক্যাচ নেওয়া যায়? যা দেখে প্রশ্ন জাগবে, রাঁচির ফার্মহাউসে নিয়মিত ম্যাচ প্র্যাকটিস করতেন নাকি লকডাউনে? প্রথম বলেই আউট হওয়ার লজ্জা মুছে নিখুঁত একটা ডিআরএস নেওয়া। ফিল্ডিংয়ের সময় একটা ডিআরএস বেকার গিয়েছিল। ব্যাটিংয়ের সময় আবার ডিআরএস ‘ধোনি রিভিউ সিস্টেম।’ বুঝতেই তো পারা গেল না, রায়না নেই। বুঝতে পারা গেল, নেতৃত্বতে, মস্তিষ্কতে জং ধরে না।
এ রকম কবি, এমন উদাসীন বালক, রাখাল, রোবট কিংবা অরণ্যদেব আমরা অনেকেই মনে মনে হতে চাই। আজীবন হতে চাই। হতে পারি না। হতে পারবও না। ধোনি পারেন এবং থেকে যান ধ্রুবতারা হয়ে।
সুনীল গাভাস্কারের চোখে ‘ভবিষ্যতের ভারত অধিনায়ক’ কে এল রাহুল, সুনীল শেঠির মেয়ে আথিয়া শেঠির প্রেমিক কেএল রাহুল—এমন ধোনিবাদ কি ভবিষ্যতে করে দেখানো আর সম্ভব?
ইচ্ছে হল তো টুইট করলেন। হয়তো রাফাল নিয়েই টুইট করলেন একটা। আবার হারিয়ে গেলেন কোথাও। সবাই প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে টুইট করছেন শুভেচ্ছা জানাতে। কোহলি পর্যন্ত। সেখানে ধোনি চূড়ান্ত ভ্রুক্ষেপহীন। ফেব্রুয়ারির পর তিনি টুইটারে আসেন অগস্টে। দুটো বা একটা। টুইটারে নিজের পরিচয় দিতে তিনি লেখেন, ‘Member TEAM INDIA, Biker, Gamer, hindi retro aficionado, an absolute pet-lover and perennially hungry for chicken butter masala.’
পরিচয়টাই অন্য রকম। এখানেও চিরাচরিত গতানুগতিকতার বাইরে, রাঁচির সেই বিখ্যাত পাঁচ ঝরনাগুলোর নিজস্ব নিয়মের জলপ্রপাতের মতো। হুড্রু, দসম, জোনহা, হির্নি, পঞ্চঘাঘ। আচ্ছা, ধোনি কি বাইক নিয়ে নিরুদ্দেশে গিয়ে কোনও ঝর্নার ধারে বসে থাকেন?
অনেকে বলবেন, এ কী! তুমি অধিনায়ক। একটা দল চালাও। সতীর্থদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে না? কোচের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে না? নির্বাচক বা বোর্ড প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলবেন না নিয়মিত? কর্পোরেট হলে যে এখন চাকরিই থাকত না তোমার। সেখানে হোয়াটসঅ্যাপেই মিনিটে মিনিটে নির্দেশ। এক মিনিট না দেখলেই তুমি এখন পিছিয়ে যাবে কাজের জায়গায়। তুমি ছাঁটাই, ভাই, নমস্কার। এ বার আসতে পারো।
সন্ধ্যারাতের অধিনায়ক ধোনি এ সবের বাইরেই থেকে গেলেন আজীবন। নিজস্ব শর্তে জীবন যাপনের কিপার হয়ে। সন্ধ্যারাতের কবি হয়ে।
ভাগ্যিস, বাইরে থাকলেন। নইলে বোঝা যেত না, কী রকম ভাবে আসলে জীবনে বেঁচে থাকা যেত। কী রকম ভাবে বেঁচে থাকা হল না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ধার করে এই ক্রিকেট কবির জন্য লেখা যায় দুটো লাইন।
‘ধোনি কী রকম ভাবে বেঁচে আছে, তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
এই কি মানবজন্ম?
প্রতি সন্ধেবেলা আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে,
হৃদয়কে অবহেলা করে রক্ত…’