একজন প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ ব্যবসায়ী কর্মসূত্রে সে বছর এসেছিলেন ভারতবর্ষে। ব্যবসার কাজকর্ম সব মেটানোর পর দেখলেন হাতে আরও একটা দিন বেশি পড়ে আছে। আবার সেই দিনই পড়েছে ভদ্রলোকের জন্মদিনটাও। সঙ্গে স্ত্রীও এসেছেন। তাই ঠিক করলেন আগামী দিনটি এখানেই কাটিয়ে তবেই দেশে ফিরবেন। বয়স তো আর কম হল না। এবার না হয় পূর্বপুরুষদের প্রিয় উপনিবেশেই জন্মদিনটা কাটুক। কিন্তু এই জন্মদিনটাই যে তাকে এক ঐতিহাসিক ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী করে রাখবে, ঘুণাক্ষরেও তা কল্পনা করতে পারেননি তিনি।
দিনটি ছিল ১৯৯৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি, রবিবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। দিল্লীতে তখন শীতকাল চলছে। বেড়ানোর জন্য আদর্শ একটি দিন হলেও স্থানীয় বন্ধুবান্ধবরা জোর করছে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাওয়ার জন্য। খেলাটি যে তার বিশেষ অপছন্দ তা কিন্তু নয় তবে বিশেষ পছন্দও নয়। টিকিট কেটে সারাদিন মাঠে বসে থাকার মত ধৈর্য ওনার কোনকালেই ছিল না। ছেলেবেলায় খেলাটি প্রচুর খেলেছেন। এমনকি বাবার সাথে একবার ম্যাচও দেখতে গিয়েছিলেন। ওনার বাবা ছিলেন ক্রিকেটের পাঁড় ভক্ত। যাই হোক, শেষমেশ বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে রাজি হয়ে গেলেন তিনি।
খেলা চলছে ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠে। টেস্ট ম্যাচের চতুর্থ দিন। ভারত বনাম পাকিস্তান। পাঁচ দিন ধরে খেললেও অনেক টেস্ট ম্যাচ অমীমাংসিত থেকে যায়। তবে এই ম্যাচের ফলাফল ছিল অনুমানযোগ্য। কেননা চতুর্থ দিনেই চতুর্থ ইনিংস শুরু হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানের সামনে ৪২০ রানের লক্ষ্য। কিন্তু পিচের যা অবস্থা শোনা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় না খেলা পাঁচ দিন মাঠে গড়াবে।
লাঞ্চ পর্যন্ত বিনা উইকেটেই কাটিয়ে দিল পাকিস্তান। খারাপ উইকেটেও বেশ ভালোই সংগ্রাম চালিয়ে গেল দুই পাকিস্তানি ওপেনার। তবে ভারতীয় বোলারদের দেখে ভদ্রলোকের বিশেষ সুবিধার ঠেকল না। লম্বা মতন করে ওই স্পিনারটিকে কেমন অস্বস্তিকর লাগল। স্পিনার তো নয় যেন ‘স্লো ফাস্ট বোলার’! কেমন লাফাতে লাফাতে ছুটে এসে জোরের ওপর বল ছোঁড়ে, কিন্তু ঘোরে কই? তবে হ্যাঁ, বোলারটির একটা জিনিসে অসম্ভব রকমের নিয়ন্ত্রণ, সেটি হল সোজা বল ছাড়ার যাকে বলে ‘স্টাম্প টু স্টাম্প’ বোলিং। যদিও তাতে কাজের কাজ খুব একটা হয়নি। ছয় ওভার বল করে ইতোমধ্যেই ২৭টি রান খরচ করে ফেলেছে সে। দেখা যাক, মধ্যাহ্নভোজন পর্ব শেষে কী খেল দেখাতে পারে সে।
লাঞ্চের পর সেই স্পিনারটি সত্যিই খেল দেখাতে আরম্ভ করল। পরপর দু’দুটো উইকেট ফেলে দেয়ার পর গোটা গ্যালারি থেকে বার বার ভেসে আসছিল, কুম্বলে! কুম্বলে! হ্যাটট্রিকটা যদিও করতে পারলেন না, তবুও মাত্র তিন ওভার বল করেই তুলে নিলেন চার-চারটে উইকেট। ভদ্রলোক বুঝলেন যে কেবল চরকির মত বল ঘোরানোতেই কৃতিত্ব নেই; তার সাথে চাই লাইন, লেন্থ, গতির তারতম্য, বাউন্সের ওঠানামা আরও কত কি!
ইতোমধ্যে কুম্বলের নয়টা উইকেটই নেওয়া হয়ে গেছে, মাত্র একটা বাকি। আরে ও কি দশটাই নেবে নাকি? এও কি সম্ভব হয়েছে কোনদিন? সমস্ত স্টেডিয়াম তখন উত্তেজনায় কাঁপছে! তারমধ্যে কুম্বলে আবার তখন ‘অন আ হ্যাটট্রিক!’ হ্যাটট্রিক করলেই দশে দশ! এ কোন অদ্ভুতুড়ে ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছেন তিনি?
দর্শকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখন বাইশ গজে, কিন্তু ভদ্রলোক একটু অন্যমনস্ক। কুম্বলের বল ঘুরুক আর নাই ঘুরুক, ভদ্রলোকের মাথার মধ্যে একের পর এক স্মৃতি বনবন করে ঘুরেই চলেছে। প্রায় তিন দশকের ব্যবসায়িক জীবনে কখনো শখ করে হলেও ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে মাঠে যান নি। বাবা নিয়ে গিয়েছিল সেই কোন ছেলেবেলায়। তারপর এ্যাদ্দিন বাদে এই স্টেডিয়ামে আসা। হঠাৎ বাবার মুখে শোনা একটা কথা মনে পড়ে গেল তাঁর, ‘ইয়ান জনসনও শেষরক্ষা করতে পারেননি!’
ক’জনই বা পারে? ক্রিকেট ম্যাচে এরকমটা প্রায়শই হয়ে থাকে যে একজন ব্যাটসম্যান প্রবল প্রতিরোধ গড়েও শেষরক্ষা করতে পারে না, জয় ছিনিয়ে নেয় প্রতিপক্ষ দল। এই ম্যাচেও না হয় তাই ঘটল। পিচের হাল দেখে ম্যাচের ফলাফল তো টসের সময়ই প্রায় নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। টস জেতো, ম্যাচ জেতো। তাই একাদশ ব্যাটসম্যান ওয়াকার ইউনুসের কাছে বিশেষ কিছু আশা করা চলে না। কিন্তু তাকেও কি বাকি নয় জনের মত নিজের উইকেটটা কুম্বলেকেই দিয়ে আসতে হবে? ম্যাচ বাঁচিয়ে শেষ রক্ষা করার চিন্তাটা তখন আকাশ কুসুম কল্পনা কিন্তু উইকেটটা তো অন্য কেউও নিতে পারে?
অবশেষে কুম্বলের শিকার হওয়া থেকে বেঁচে গেলেন ওয়াকার। কিন্তু বলি হতে হল অপরজনকে (ওয়াসিম আকরাম)। পাকিস্তান ম্যাচ তো হারলই তার সাথে অনিল কুম্বলেকে দিয়ে গেল দশ দশটা উইকেট! বিশ্বরেকর্ড!
ইংরেজ ভদ্রলোক আবেগে আপ্লুত। জন্মদিনের বিশেষ চমক উপহারটা যে কখনো ভোলার নয়! পাশে বসে থাকা স্ত্রীও তার এই উত্তেজনা টের পেয়েছেন। স্ত্রীও ভালই উপভোগ করেছে ম্যাচটি। ভদ্রলোক উত্তেজনায় পাশের দর্শকটির সাথে গল্প জুড়ে দিলেন, ‘জানেন, সেই দশ বছর বয়সে বাবার সাথে একবার মাত্র ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম, আর এতদিন পর…’
ম্যাচ শেষ। দর্শকরা এবার উৎফুল্ল মনে যে যার বাড়ি ফিরে গেল।
জিম লেকার নামে ইংল্যান্ডের এক অফ স্পিনার ছিলেন যিনি কুম্বলের অনেক আগেই এই রেকর্ড করে বসে আছেন! এক ইনিংসে দশটা উইকেট তো তিনি নিয়েছেনই; সাথে গোটা একটা টেস্ট ম্যাচ থেকে নিজের ঝুলিতে পুরেছেন ১৯ খানা উইকেট! সেই অনন্য কীর্তি গড়ার দিনেও নিশ্চয়ই অনেক ভাগ্যবান দর্শক মাঠে উপস্থিত ছিলেন। কী আশ্চর্য! রিচার্ড স্টোকস নামের ইংরেজ সাহেবটি নাকি সেই ঘটনারও প্রত্যক্ষদর্শী!
১৯৫৬ সালের কথা। ১০ বছরের বালক রিচার্ড স্টোকস বাবার হাত ধরে গিয়েছিল ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে; ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট ম্যাচ দেখতে। বাবা ছিলেন সারের বি ডিভিশনের ক্রিকেটার। সেটিই ছিল ওই ক্ষুদে বালকের জীবনের প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতা। সেই ঘটনার ঠিক ৪৩ বছর পর ফিরোজ শাহ কোটলাতে তাঁর দ্বিতীয়বারের মত মাঠে আসা! যদিও তাঁর কাছে জিম লেকারের বেশিরভাগ স্মৃতিই এখন ঝাপসা, তবে একটা জিনিস বেশ মনে পড়ে যে এগারো জনের মধ্যে একমাত্র অপরাজিত ব্যাটসম্যানের নাম ছিল ইয়ান জনসন।