ঈশ্বর থাকেন ওই ন্যাপোলির বাতাসে

ম্যারাডোনা ন্যাপলসের দেবতা। তার শরীর না থাকুক, ছায়াটা আজও টিকে আছে ওই ন্যাপলস শহরে।

ন্যাপোলি কোন নামজাদা দল না। শেষ দুই মৌসুমে রেলেগেশন জোন কোনমতে কাটিয়ে টিকে রয়েছে সিরি এ-এর লড়াইয়ে। প্রতিপক্ষ হেলাস ভেরোনার মাঠে সর্বশেষ দেখায় নাস্তানাবুদ হয়েছে ন্যাপোলি। সময়টা সাল ১৯৮৫।

খেলার মাঠে নিয়মিতই ধরাশায়ী ন্যাপোলির সমর্থকদের যে ভেরোনার সমর্থকেরা মানুষ বলে গন্য করতেই নারাজ। নেপলস যেন ইতালির অংশই নয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য, আভিজাত্যের গৌরবের পাশে, গরীব, মেছো, অশিক্ষিত বস্তিবাসী কে-ই বা মানতে চায়।

লাভাতেভি! লাভাতেভি! ভেরোনা সমর্থকদের গর্জনে ফেটে পড়েছিলো পুরো স্টেডিয়াম। দলকে উজ্জীবিত করা কোন স্লোগান নয়, ‘লাভাতেভি- পরিষ্কার হয়ে এসো’ – প্রতিপক্ষের প্রতি নিদারুণ তুচ্ছতা, বিদ্বেষে  ভরা অসম্মানজনক এক কটুক্তি।

গরীব, জেলে নাপোলিয়ানদের নিয়ে ধনী ভেরোনাবাসীর ঘৃণা ভরা বিদ্বেষ। ন্যাপোলি নোংরা, অপরিচ্ছন্ন খেলোয়াড়দের আতুরঘর। তাই তাদের চিৎকার, পরিষ্কার হয়ে এসো।

উত্তর জানান দেয়ার দরকার ছিল। ফুটবল মাঠের লড়াই ছাপিয়ে এই লড়াই তখন পৃথিবীর আনাচে কানাচে থাকা সকল সুবিধাবঞ্চিত মানুষের লড়াই, ধনী প্রভুগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবহেলিত গোষ্ঠীর জবাব দেয়ার লড়াই। নাপোলির প্রয়োজন ছিল একজন মেসিয়াহ’র, একজন ত্রানকর্তার।

ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা, নাপোলির ত্রাণকর্তা, খেলোয়াড়দের টানেলে নিবিষ্ট মনে বুটজোড়ার ফিতে বাঁধছেন। বার্সেলোনা থেকে নেপলস নগরে ম্যারাডোনা যেন এসেছেন ত্রাণকর্তা হতেই।

রেকর্ডসংখ্যক ট্রান্সফার ফি-ই দাবি করেছিল বার্সেলোনা, নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে সেই দাবি মেটাতে চেয়েছিল নাপোলিও। তবুও শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসে বার্সেলোনা, অতিরিক্ত পাঁচ লাখ ইউরো চাই।

সেবার ন্যাপলসের মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। ক্ষুধার্ত, আধ-পেটা মানুষগুলো নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে পূরণ করেছিল অতিরিক্ত পাঁচ লাখ ইউরো। ম্যারাডোনাকে যে চাই চাই।এমন অভাবনীয় দৃশ্য কে দেখেছে কবে!

কিংবা নাপোলির মাঠে ম্যারাডোনার প্রথম দর্শন। ৭০০০০ দর্শকের সমস্বরে চিৎকার, ‘আও ভিস্তো ম্যারাডোনা, আও ভিস্তো ম্যারাডোনা’ – আমি ম্যারাডোনাকে দেখেছি, আমি ম্যারাডোনাকে দেখেছি।

ম্যারাডোনাকে প্রতিদান দিতেই হত। মাঠের ধারে টানেলের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো এক ছায়া। বুটের ফিতা শক্ত করে বাঁধা, পিঠে ১০ নম্বর জার্সি। সাড়ে পাঁচ ফুটের বেঁটেখাটো শরীর নিয়েই ন্যাপলসের জেলে পাড়া থেকে উঠে এসেছেন স্বয়ং রোমান কোন দেবতা।

ভেরোনা তো নস্যি, প্রায় ৪০ গজ দূর থেকে ছোড়া গোলা পরাস্থ করবে যে কোন নশ্বরকেই। তৈরি হলো ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলের উপাখ্যান। শুরু হলো ন্যাপোলির ইতিহাস।

সেই ইতিহাসে নাপোলির প্রথম সিরি এ জেতার গল্প আছে, প্রথম ইউরোপিয়ান ট্রফি জয়ের গল্প আছে। সবথেকে বেশি আছে সম্ভবত অধিকার আদায়ের গল্প। অবহেলিত নেপলসের মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার অধিকার।

নাপোলির একজন নিজস্ব নায়কের প্রয়োজন ছিল। তাদের মধ্য থেকে উঠে আসা একান্তই নিজস্ব নায়ক। ম্যারাডোনার জন্ম আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে, একই পরিবেশে। তাই হয়ত হয়ে উঠতে পেরেছিলেন নাপোলির নিজস্ব নায়ক।

ম্যারাডোনা কি তবে দেবতা ছিলেন? নারী কেলেঙ্কারি, মাদক কেলেঙ্কারি, মাফিয়া গ্রুপের সাথে সখ্যতা দিয়ে ম্যারাডোনা বারবার জানাতে চেয়েছেন, তিনি রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। তার মধ্যেও পাপ আছে, লালসা আছে, আছে পতিত জীবন।

ন্যাপলসবাসীর তাতে থোড়াই কেয়ার! মানুষ যদি দেবতা হয়ে দাঁড়ায়, তাতে তার ভুল মুছে যায় না। তাতে তার দেবত্বেও আঘাত লাগে না। ম্যারাডোনা যতটা আর্জেন্টিনার, ততটাই নেপলসেরও।

কিংবা, ন্যাপলসের একটু বেশিই হয়ত। ম্যারাডোনা ন্যাপলসের দেবতা। তার শরীর না থাকুক, ছায়াটা আজও টিকে আছে ওই ন্যাপলস শহরে।

Share via
Copy link