বাংলাদেশের খেলাধুলা অঙ্গনে অতি পরিচিত নামগুলোর মধ্যে থাকলেও জনপ্রিয়তায় অনেক পিছিয়ে জিমন্যাস্টিকস। এই খেলার কোন খেলোয়াড়ের কথাও মানুষজনের জানা নেই। সেখানে কিছুটা হলেও পরিচিত বলা যেতে পারে মার্গারিটা মামুন ও সাইক সিজার। দুজনেরই জন্ম দেশের বাইরে, তাই তারা পুরোপুরি বাংলাদেশি নয়।
সেখানে আবার এগিয়ে রয়েছে মার্গারিটা। রাশিয়া জন্ম নেওয়ার পর জিমন্যাস্টিকসে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। বিশ্ব জিমন্যাস্টিকসে আলোক উজ্জল একটি নাম মার্গারিটা মামুন। নামের শেষাংশ দেখে বাংলাদেশের পরিচয় পাওয়া যায়। রাজশাহীর কৃতি সন্তান আবদুল্লাহ আল মামুন মার্গারিটার বাবা। মূলত বঙ্গবন্ধু পঞ্চম আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকস উপলক্ষ্যেই তার জন্মদাতার দেশ বাংলাদেশে আগমন।
অংশগ্রহনকারী দেশগুলোর খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেবার পাশাপাশি কাজ করেছেন শুভেচ্ছা দূত হিসেবে। এর আগে একবারই লাল সবুজের মাটিতে পা রাখতে পেরেছিলেন। এরপরের সময়টা ব্যস্ততার কারণে তার আর এদেশে আসার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এবার এসে থাকলেনও কিছুদিন।
ব্যস্ততার মধ্যে খেলোয়াড়দের পাশাপাশি সময় দিয়েছেন সংবাদ মাধ্যমকেও। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার অনেক অজানা কথাও এসময় শোনা গেছে। নিজের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় অর্জন অলিম্পিক স্বর্নপদক নিয়েও রাজধানী ঢাকার ফুটপাতে দাড়িয়ে ছবি তুলেছেন। সাংবাদিকরাও এই সুযোগটা নিতে ছাড়েননি। রাশিয়ান স্বর্ণ কণ্যা হিসেবে পরিচিত র্মাগারিটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাই অতি পরিচিত নাম।
কারও কাছে তো ২০১৬ রিও অলিম্পিক গেমসে জেতা পদকে ভাগ রয়েছে লাল সবুজ দেশেরও, এমনটাই মনে করেন। দীর্ঘ ১৫ বছর পর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেন্ট্রাল সাউথ এশিয়ান আর্টিস্টিক জিম্যানাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশীপ। রিও অলিম্পিক গেমসে রিদমিক জিম্যানস্টিকস অলঅ্যারাউন্ড ইভেন্টে স্বর্ণপদক জয়ী মার্গারিটা এবার মামুন তার পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন।
সফরে তার সঙ্গে ছিলেন এক পুত্র সন্তান লেবস, রাশিয়ান স্বামী আন্তর্জাতিক সাঁতার পদকপ্রাপ্ত আলেকসান্দার এবং মা এনা মামুন। যদিও মা আর মেয়ে এর আগে একবার এসেছিলেন। মার্গারিটার বাবা মারা গেছেন ২০১৬ রিও অলিম্পিক গেমস চলাকালীন সময়ে। যখন মেয়ে স্বর্ণ জিতে আনন্দে ভাসছিলেন, ঠিক তখনই বাবা হারানোর বেদনায় ভুবনহারা হয়ে যান।
এর আগেই এদেশের খেলাপ্রিয় মানুষজন জেনে গিয়েছিল বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন নারী স্বর্ণ জয়ের সুখবর খবর দিয়েছেন। আনন্দটা স্বর্ণ জয় করার পর তার মনটা বেশ ভালো ছিল না। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট নিয়ে তারপরও সেদিন হাসি মুখে কথা বলতে হয়েছিল সংবাদকর্মী থেকে শুরু থেকে সবার সঙ্গে। ক্যারিয়ারের শুরুতে জিমন্যাট হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মাত্র চার বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন মার্গারিটা।
দেড় দশক আগেও বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার মূল্যায়ান ছিল অনেকটা এরকম, ’আমার মা রাশিয়ান আর বাবা বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন। সে হিসেবে আমি অর্ধেক বাংলাদেশি অর্ধেক রাশিয়ান।’ তাহলে তো অলিম্পিক স্বর্ণে বাংলাদেশেরও ভাগ আছে, এমনটা শোনার পর যারা হেসে দিয়েছিলেন তারা দাবী করতেই পারেন।
বাবার জন্মভিটা রাজশাহীর বিখ্যাত আম, সেখানকার তৈরি সিল্ক যে কতটা জনপ্রিয়, সেটাও জানা তার বেশ জানা আছে। রাজশাহীর আম তার কতটা প্রিয় সেটা জানাতে সংবাদকর্মীদের বলতে ভোলেননি, ’আমার জানামতে কেউ যদি রাজশাহীতে বেড়াতে যায়, তাহলে বলি আমার জন্য কার্টুন ভরে আম আনবে। রাজশাহীর সিল্কও আমার অনেক পছন্দ। ইচ্ছে ছিল বাংলায় কথা বলব, তবে সেটি আর হয়ে উঠেনি।’
এদিকে সেই ছোটবেলা থেকেই বাংলা এবং ইংরেজি কোনটাই ভালো দক্ষতা না থাকায় দোভাষীর মাধ্যমে রাশিয়ান ভাষায় কথা বলেন তিনি। জাতিসংঘের নারী দূত হয়েও অনেকদিন ধরে কাজ করে চলেছেন মার্গারিটা। ভবিষ্যতে ইচ্ছে আছে বাংলাদেশের নারী সমাজের উন্নতির জন্যও কাজ করবেন। নারী জাতিকে সাহস দেওয়ার কাজটি সব সময় করতে চান তিনি।
নারী খেলোয়াড়দের পোশাক নিয়ে মার্গারিটা কিছুটা আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আমি সর্বশেষ টোকিও অলিম্পিক গেমসেও দেখেছি মিশরের মেয়েদের পোশাক নিয়ে নানা কথা বলতে। মুসলিম নারীরা কীভাবে খেলছেন সেটা দেখার পর বলেছি, আসলে পোশাক কোনো ব্যাপার নয়। ধর্ম, পরিবেশ এসব নিয়ে এখনো যদি কেউ কথা বলেন সেটাকে দুঃখজনক বলা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।’
এছাড়া বঙ্গবন্ধু সেন্ট্রাল সাউথ এশিয়ান জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের জিমন্যাটদের উৎসাহ দিতে এবার ঢাকায় এসেছেন রিও অলিম্পিকের স্বর্ণজয়ী এই অ্যাথলেট। স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও এবারের এই প্রতিযোগিতায় ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও উজবেকিস্তান অংশগ্রহন করছে।
আফগানিস্তানের অংশ নেয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত নিজেদের দেশে সৃষ্ট ক্ষমতার দ্বন্ধে থাকা ঝামেলার কারণে তারা আসেনি। বাংলাদেশের ১২ জিমন্যাটসহ সর্বমোট ৬৭ জন অংশ নিচ্ছেন এই আসরে। সিনিয়র পুরুষ, সিনিয়র মহিলা ও জুনিয়র ক্যাটাগরিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই চ্যাম্পিয়নশিপে। এক দশক আগে ২০১১ সালে সর্বশেষ এই টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের মাটিতে।
মার্গারিটার বাংলাদেশে আগমনের বিষয়ে জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন সভাপতি ও বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) শেখ বশির আহমেদ মামুন বলেন, ‘মূলত তরুন জিমন্যাটদের উৎসাহ দিতেই মার্গারিটা মামুনকে আনা হয়েছে। টুর্নামেন্টের উদ্বোধনের পাশাপাশি পরের দিনও তিনি খেলা দেখেন। তাকে এই টুর্নামেন্টে বিশেষ আমন্ত্রণ জানানোর আরেকটি কারণ হচ্ছে, তাকে দেখে যেন আমাদের মেয়েরা উজ্জীবিত হয়। মার্গারিতা মামুন রাশিয়ায় থাকলেও তার শরীরে বইছে বাংলাদেশের রক্ত। বাংলাদেশের প্রতি তার অন্যরকম একটা টানও রয়েছে, সেটা এবার বাংলাদেশের মানুষ বুঝেছেন।’
সেই টান থেকেই বাংলাদেশে আগমন এই ভুবনজয়ীর। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যহত রাখতে চায় বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন। উঠতি তরুণদের কাছে অনুপ্রেরণার নাম। সেটাকে এই টুর্নামেন্ট দিয়ে কতটা কাজে লাগাতে পারেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।