এই মৌসুমের এসি মিলানকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এক জ্লাতানের ছোয়ায় যেন আপাদমস্তক পালটে গিয়েছে ইতালিয়ান জায়ান্ট। গত এক দশক ধরে ইউরোপিয়ান ফুটবলে খাবি খাওয়া মিলান এখন সবাইকে সরিয়ে ‘টপ অফ দ্যা টেবিল’। ইতালিয়ান লিগে একাই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে জ্লাতান ও কোং। কিন্তু তাঁর বয়সও তো কম হলো না, এবছরই ৪০-এ পা দিবেন জ্লাতান। তার বিশ্রাম আর চোটের সময় হাল ধরবার মতন আস্থার পাত্র খুঁজছিল মিলান।
আর সেজন্য ৩৪ বছর বয়সী মারিও মানজুকিচকে কিনে এনেছে মিলান। ইতালিয়ান লিগে মানজুকিচের অভিজ্ঞতা কম নেই। রাইভাল জুভেন্টাসে খেলেছেন ৪ বছর। ২০১৯ সালে জুভে ছেড়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখান থেকে চুক্তি শেষে বসে ছিলেন মৌসুমের শুরু থেকে।
দলহীন হয়ে থাকা ওয়ার্ল্ড কাপ রানার-আপকে তাই ছয় মাসের জন্য দলে নিয়েছে মিলান। আর তাকে দুহাত বাড়িয়ে স্বাগত জানিয়েছেন সুইডিশ স্ট্রাইকার। ক্রোয়েশিয়ান স্ট্রাইকারকে দেওয়া হয়েছে ‘৯’ নম্বর জার্সি। কিন্তু গত এক দশকে মিলানের বাজে ফর্মের মতন ‘৯’ নম্বর জার্সির ইতিহাসও ম্লান। সেই ম্লান জার্সিকে আবারও পুরোনোরূপে ফেরত এনে হতে পারবেন কী ‘সুপার মারিও’?
‘দ্যা সুপারপিপ্পো কার্স’-এর সূচনা হয়েছিল ফিলিপ্পো ইনজাঘির হাত ধরে। মিলানের ইতিহাসের অন্যতম ইনফ্লুয়েন্সিয়াল তারকার নাম ফিলিপ্পো ইনজাঘি। আদর করে যার নাম ‘পিপ্পো’ দিয়েছিল মিলান সমর্থকেরা। শেষ ২০১১ তে লিগ জিতেছিল মিলান। সেই মিলানের অ্যাটাকিং থার্ডে ছিলেন ইব্রাহিমোভিচ, রবিনহো, পাতোর মতন সম্ভাবনাময় তারকা। আর তাদের লিডার ‘জার্সি নস্বর ৯’ ছিলেন বিশ্বকাপজয়ী ইতালিয়ান স্ট্রাইকার ফিলিপ্লো ইনজাঘি। টানা ১১ বছর সামলেছেন সে পজিশন। জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ, লিগ, ক্লাব বিশ্বকাপ।
এরমধ্যেই ইতালিকে এনে দিয়েছেন নিজেদের চতুর্থ বিশ্বকাপ। এক কথায় সর্বঅজয়ী হয়েছিলেন এই মিলানের নয় নম্বর জার্সি পরে। যদিও এই সময়ে স্ট্যাটটা বেমানন লাগে, কিন্তু সেই যুগে ২০২ ম্যাচে ৭৩ গোল করে ইনজাঘির হয়ে উঠেছিলেন ইউরোপের ত্রাস। ইতালি-ইউরোপ থেকে বিশ্ব জয় করে ২০১২ সালে ৩৯ বছর বয়সে ফুটবলকে বিদায় বলেন মিলানের ‘পিপ্পো’।
সেই শেষ, এরপর থেকে মিলানের নম্বর নাইন যে পথ হারালো, তা আর খুঁজেই পায়নি কেউ। গত ৯ বছরে ১০ জন মিলানের এই জার্সি নম্বর গায়ে জড়িয়েছেন, তাদের পা থেকে গোল এসেছে মাত্র ২৯ টি! তাই এই জার্সির অভিশাপের এক মুখরোচক নামও বেরিয়েছে, ‘দ্যা সুপারপিপ্পো কার্স’।
কিন্তু এই কার্সের পেছনের গল্পটা কি আসলেই কোনো অভিশাপ? নাকি মিলানের মতন এই ‘৯’ নম্বর জার্সিও নিজের ফর্ম হারিয়ে ফেলেছিল? বছরের পর বছর কেটেছে, মিলানের ৯ নাম্বার জার্সি কম মানুষের গায়ে জড়ায়নি। কিন্তু সেরা ফর্মে থাকা খেলোয়াড়ও এই জার্সি গায়ে দিয়ে হয়ে গিয়েছেন মলিন, বিবর্ণ। তাই বারবার ঘুরে ফিরে প্রশ্ন এসেছে, এসি মিলানের ঐতিহ্যবাহী ৯ নাম্বার জার্সি কি তবে অভিশপ্ত?
গল্পের শুরুটা করা যাক ইনজাঘির পর জার্সির হাত বদল দিয়ে। ইনজাঘির পর মিলানের ‘৯’ নম্বর জার্সি তুলে দেওয়া হয় আলেক্সান্ডার পাতোর গায়ে। ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে বড় আক্ষেপের নাম বলা হলে তাতে সবার উপরে নাম আসবে পাতোর। অপর সম্ভাবনা নিয়ে ঠিকই এতদিন খেলছিলেন পাতো। টুকটাক চোট থাকলেও, খেলাতে ঠিকই নিজের বিধ্বংসী মনোভাব দেখাচ্ছিলেন।
বাহুডোরে ছিল মিলান প্রেসিডেন্টের মেয়ে, সিলভিও বার্লুসকোনি। কিন্তু ‘৯’ নম্বর জার্সি পাওয়ার পর থেকেই যেন সব ভেঙ্গে পরতে শুরু করল। চোটের পর চোট, ফর্ম হারানো, এমনকি হারিয়ে ফেললেন এতদিনের প্রেমিকাকেও। প্রেসিডেন্টের মেয়ে বলে কথা, পাতোকে পাঠিয়ে দেন করিন্থিয়ান্সে। এখন পর্যন্ত সেই দূরাবস্থা থেকে ফিরতে পারেননি পাতো।
এরপরে মিলানের ঐতিহ্যবাহী জার্সি পান আলেসান্দ্রো মাত্রি, জুভেন্টাস থেকে মিলানে আসা এই ইতালিয়ান ছিলেন এক মৌসুম, ১৫ লিগ ম্যাচে গোল পেয়েছিলেন মাত্র ১ টি। পরের মৌসুমেই মিলান ছেড়ে ফিওরেন্তিনায় পাড়ি জমান তিনি।
পরের মৌসুমে ধারে মিলান কিনে আনে লিজেন্ডারি ফার্নান্দো তোরেসকে। যদিও তোরেস তার সেরা সময়টা পেছনে ফেলে এসেছেন অনেক আগেই, কিন্তু তাও অভিজ্ঞতার একটা মূল্য আছে না? কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। ১০ ম্যাচে ১ গোল করে অর্ধেক মৌসুমেই দল ছাড়েন তোরেস। আর মৌসুমের বাকি অর্ধেকে জার্সি গায়ে চড়েছিল মাতিয়া দেস্ত্রোর। তিনিও মৌসুম শেষ করেন ১৫ ম্যাচে ৩ গোল নিয়ে।
এরপরে অনেক হাত বদল হয়েছে, অনেকে সম্ভাবনা, অভিজ্ঞতার হিসেব-নিকেশ হয়েছে; কোনো কিছুতেই মুক্তি মিলেনি। শাখতার থেকে আসা ব্রাজিলিয়ান লুইজ আদ্রিয়ানো, ইতালিয়ান জিয়ানলুকা লাপাদুলা, পর্তুগালের আন্দ্রে সিলভা; প্রত্যেকেই দলে এসেছিলেন অমিত সম্ভাবনা নিয়ে। আর দল ছেড়েছেন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিলেন লাপাদুলা। ২৭ ম্যাচে ৮ গোল নিয়ে গত দশ বছরে সবচেয়ে সেরা তিনিই।
‘আমি ইতোমধ্যেই অনেক ঐতিহ্যবাহী জার্সি গায়ে জড়িয়েছি, মিলানের নয় নম্বর জার্সি কোনো সমস্যা নয়, আশা করছি যে আমি সফল হবো!’ জুভেন্টাস থেকে ধারে এসে বেশ কথার ফুলি ফুটিয়েছিলেন গঞ্জালো হিগুয়েইন। ভরসাও ছিল।
রিয়াল, নাপোলি, জুভেন্টাসে সফল হয়েই মিলানে এসেছিলেন। মিলানে ভালো কিছু করতে পারবেন বলেই আশা ছিল। আর এতোদিন পর একজন ভালো ইনফর্ম তারকা পেয়ে মিলানও খুশি ছিল। যদি এবার ভালো কিছু হয়? ফলাফল অর্ধেক মৌসুমেই কোচের সঙ্গে ঝামেলা, ১৫ ম্যাচে ৬ গোল, আর এরপর জুভেন্টাসে ফেরত যাওয়া।
হিগুয়েন চলে যাওয়ার পরেই মিলান কিনে আনে পোলিশ স্ট্রাইকার ক্রিস্টফ পিওন্তেককে। জেনোয়ার হয়ে অসাধারণ এক মৌসুম কাটিয়ে মিলানে যোগ দিয়েছিলেন ক্রিস্টফ। ২০১৯-এর জানুয়ারিতে মিলানে আসেন পিওন্তেক। ক্লাবের অনেকেই চেয়েছিলেন মিলানের ৯ নাম্বার জার্সি তার গায়ে তুলে দিতে। কিন্তু ক্লাব ডিরেক্টর লিওনার্দো বলেছিলেন, ‘এ জার্সি এমনি এমনি পাওয়া যায় না, অর্জন করে নিতে হয়।’
পিওন্তেক যেন অর্জন করার পেছনেই ছুটছিলেন। ১৯ নম্বর জার্সি গায়ে দিয়ে মৌসুমের বাকি অর্ধেক তাণ্ডব চালিয়েছিলেন মাঠে। ১৮ ম্যাচে ১১ গোল। ফলস্বরূপ নতুন মৌসুমেই তার গায়ে তুলে দেওয়া হয় ঐতিহ্যবাহী ‘জার্সি নম্বর ৯’! কিন্তু এ জিনিস ‘অর্জন করার থেকে রক্ষা করা কঠিন’। জার্সি পেয়েই যেন বেমালুম ভুলে গেলেন গোল করতেপরের ১৮ ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে বল ঢুকিয়েছিলেন মাত্র ৪ বার! যার কারণে তাঁকে অর্ধেক মৌসুমেই বিদায় বলে দেয় মিলান।
তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে, মিলান তবে চলছে কীভাবে? প্রশ্নের উত্তর একটু ভিন্ন। মিলানের স্ট্রাইকারদের গোলখরা নয়, চলছে ‘নম্বর নাইন’দের। মিলানে এসে জ্লাতানও ৯ নম্বর নেননি, বেছে নিয়েছিলেন ‘২১’। মৌসুম শেষে আবার অবশ্য পুরোনো ‘১১’তে ফিরেছেন তিনি। মিলানের জার্সিতে ইনজাঘি যাওয়ার পর ১০ গোল করতে পেরেছেন মাত্র ৭ জন স্ট্রাইকার – স্টেফান এল শারাওয়ে, জিয়ামপাওলো পাজ্জিনি, মারিও বালোতেল্লি, কার্লোস বাক্কা, প্যাট্রিক কুট্রোন, আন্তে রেবিচ ও সর্বশেষ জ্লাতান; অথচ কেউই পরেননি ট্র্যাডিশনাল স্ট্রাইকারদের ‘৯’ নম্বর জার্সি।
তালিকার সর্বশেষ সংযোজন মারিও মানজুকিচ। তিনিও মিলানে আসতে না আসতেই পরেছেন চোটের কবলে। মিলানের অ্যাটাকিং থার্ডের গোলক্ষরার দিনে তিনি করতে পারছেন না কিছুই।
মার্কো ভ্যান বাস্তেন, জর্জ উইয়াহ কিংবা ইনজাঘির মতন বিশ্বকাঁপানো তারকারা এই জার্সি পরে মাঠে কাঁপিয়েছেন। ইউরোপ জুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন তারা। যে জার্সি এতকাল ছিল মিলানের ‘মাইডাস টাস’, স্পর্শেই স্বর্ণ ফলতো, তাই আজ অভিশপ্ত। সোনা আর ফলে না, বরং জার্সি গায়ে দিয়ে নিজেরা হয়ে যান জলজ্যান্ত মূর্তি। ব্যর্থ হয়ে একেকজন ছেড়েছেন এই পদ। ‘মাইডাস টাচ’ নাকি মিডাসের টাচ; ‘সুপার মারিও’ মানজুকিচ এখন কোনটা হন সেটাই দেখার জন্য উন্মুখ সকলে।