একটি অসমাপ্ত ৯৯৯

টওন্টনের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চলল প্রায় তিন ঘন্টা ধরে সার্জারি। উইকেটের বেলটা ছিটকে গিয়ে চোখের স্ক্লেরা প্রায় নষ্ট করে দিয়েছে। হাসপাতালের বেডে লড়াই করে চলেছে এক অসমাপ্ত যোদ্ধা।

কত লড়াই সামলে এসেছে সে,কিন্তু স্বপ্নেও ভাবেনি ঠিক এইভাবে শেষের পথে তলিয়ে যাবে সে। কি পেয়েছিল সে? কিছুই তো পায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসে জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়া তো আর মুখের কথা ছিলনা।

সার্জারি চলল প্রায় তিন ঘন্টা ধরে। ডাক্তারি ভাষায় বলতে গেলে বলা যায় – ‘A lacerated Wound in the sclera of Eye’।

সময়টা ২০১২ সালের ১০ জুলাই। দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছিল ইংল্যান্ড সফরে। টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা মুখোমুখি হয়েছিল কাউন্টি ক্লাব সমারসেটের বিপক্ষে। তখন উইকেটে ব্যাট ঠুকছেন জামিল হুসাইন, বল করতে আসছিলেন ইমরান তাহির, আর উইকেটের পিছনে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা দলের ১৪ বছরের যোদ্ধা মার্ক বাউচার।

সারাজীবন চোকার্স খ্যাত দলটার এই একমাত্র যোদ্ধাকেই সমালোচনা করার সাহসটুকু দেখাতে পারেননি এ বিশ্বের তাবড় তাবড় রথী মহারথীরাও। ম্যাচ ধরা থেকে শুরু করে ম্যাচ ফিনিশারের ভূমিকায় বাউচার যে কত তরী পার করিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।

২০০৬ সালে ওয়ানডে সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার ৪৩৪ এর অসম্ভব টার্গেটকে চূর্ণ করে ৪৩৮ রান তুলে ম্যাচ আর সিরিজ পকেটে পুরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।সেদিন গিবসের ১৭৫ আর পন্টিংয়ের ১৬৪ তে চাপা পড়ে গিয়েছিল বাউচারের ৪৩ বলে নট আউট থাকা ৫০ রান আর তার সাথে চাপা পড়ে গিয়েছিল এক উইকেট বাকী থাকতে তার চার মেরে ম্যাচ জেতানো ইনিংসটা।

আসলে এ বিশ্বে সেঞ্চুরির ঔদ্ধত্যে বারবার চাপা পড়ে গেছে অনেক অনেক ক্যামিও। কিন্তু সেদিন অন্তত চিরাচরিত চোকার্স শব্দটা মুছে ফেলে চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়ে ভরা দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে গিয়েছিল সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। ভেঙে চুরমার করেছিল অস্ট্রেলিয়ান ঔদ্ধত্যকে।

আর সেই জয়ের মহাকাব্যের পেছনে শেষ পাতা হয়ে রয়েছিল বাউচারের সেই ৪৩ বলে ৫০। যেটা না হলে আবারো ১৯৯৯ এর সেমিফাইনালের অভিশাপটা দক্ষিণ আফ্রিকার কপালে জুটত আরেকবার, জুটতো চোকার্সের অপবাদ।

তিনিই সেই মার্ক বাউচার। দক্ষিণ আফ্রিকার সোনার দলের এক ক্ষুদ্র নাম, কিন্তু যে নামটি না হলে এই বিশ্ব পেতনা মাইকেল বেভানদের উত্তরসুরীকে। মাইকেল বেভান ও মহেন্দ্র সিং ধোনি ছাড়াও আরো একজন ছিল যে পারত চাপ সামলে ৪৩৫ এর টার্গেটটা ছুয়ে অন্তত একবারের জন্যেও সর্বহারা একটা চোকার্স খ্যাত জাতিকে চ্যাম্পিয়ন এর স্বাদ দিতে, যে পারত শন পোলকের বলে গিলক্রিস্টের ক্যাচ ধরেও আম্পায়ারকে সৎভাবে বলতে – ‘The ball has already touched the ground’।

গিলক্রিস্টকে অনেক পিছনে ফেলে সে উঠে আসছিল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ উইকেট রক্ষক হিসাবে। টেস্টে ৫৫৫ টা ডিসমিসাল তার, অনেক পেছনে গিলক্রিস্ট(৩৭৯)। আর আন্তর্জাতিকে তখন তার শিকারের সংখ্যাটা ৯৯৯*। জীবনের ১৫০ তম টেস্ট আর ১০০০ আন্তর্জাতিক শিকারটাকে স্পর্শ করতে সে শেষবারের জন্য ইংল্যান্ড সফরে এসেছিল জাতীয় দলের সাথে।

কিন্তু হঠাৎ দুর্ঘটনা। প্র‍্যাকটিস ম্যাচে ইমরানের ছোঁড়া বল সমারসেটের জামিল হুসেনের উইকেটকে ভেঙে দিল,কিন্তু সেই উইকেট থেকে ছিটকে পড়া বেল সোজা আঘাত হানল পিছনে নির্বিকার হয়ে চেয়ে থাকা সেই যোদ্ধার চোখে। মাটিতে লুটিয়ে যখন পড়ল সে,তখন চোখ দিয়ে গড়াচ্ছে রক্তের ধারা।

টানা তিন ঘন্টার আই সার্জারির পর, তার জ্ঞান ফিরল। হয়তো সে তখন স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল বিশ্বের প্রথম রক্ষক হিসেবে লর্ডসের মাঠে ১০০০ টা ডিসমিশালের রেকর্ড করে একটা দৌড়ের ,হয়তো বা স্বপ্ন দেখছিল দেশের হয়ে অন্তত একবার বিশ্বকাপ জিতে চোকার্স এর অপমানটা সারাজীবনের জন্য ঘুচিয়ে দেবার। জ্ঞান ফিরল যখন তাকানোর চেষ্টা করলেন চারিদিকে। কিন্তু!

বুঝে গেলেন সব শেষ। ১০০০ স্পর্শ করার এক ধাপ আগে থেমে গেল তার ক্রিকেটজীবন।আসলে ভাগ্য তো সবাইকে জিততে দেয়না। তাই থেমে গেল ১৪ বছরের এক যোদ্ধার ক্রিকেট জীবন। অসমাপ্ত ৯৯৯ এর স্বপ্ন নিয়ে অকাল অবসরে চলে গেলেন মার্ক বাউচার।পাশে পড়ে রইল কিছু শুকনো গোলাপ আর একটা অসম্পূর্ণ ৯৯৯!

এটাই দক্ষিণ আফ্রিকা। নিজেরা কোনোদিনও পারেনি চ্যাম্পিয়নশিপের স্বাদ নিতে,কিন্তু সারাজীবন ধরে তৈরী করে গেছে চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়, আর তাদের জীবন শেষটা যেন ট্র‍্যাজেডির শেষ পাতা, সে ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপ সেমিতে ক্লুজনারের আপ্রাণ চেষ্টার অসহায় ব্যর্থতাই হোক, কিংবা ২০১৫ বিশ্বকাপ সেমিতে দলের সর্বদক্ষ ফিল্ডার ডে ভিলিয়ার্সের অপ্রত্যাশিত রান আউট মিস।

সম্রাট নেপোলিয়ন একবার বলেছিলেন – ‘Real Heroes are all time Tragic’। তাই তো হাজার যুদ্ধ জেতানো বাউচারকে হারিয়ে দিল একটা উইকেটের বেল আর তিন ঘন্টার সার্জারি। আর পাশে পড়ে রইল কিছু শুকনো গোলাপ। ওগুলো কি গোলাপ? নাকি অসমাপ্ত ৯৯৯? ঠিক জানিনা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link