দু:খী রাজপুত্রের ঠোঁটে হাসি

তিনটা কোপা আমেরিকা আর একটা বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে ওঠেও শিরোপা জেতা হয়নি লিওনেল মেসির। এবার ব্যর্থতার পঞ্চম আর সফলতার প্রথমের সামনে দাড়িয়েছিলেন এই সুপারস্টার। তার পাশে আবার ২৮ বছরের শিরোপা খরা ছিল আর্জেন্টিনার।

১৯৯৩ সালের পর আর যে জেতা হয়নি মহাদেশীয় ফুটবল শ্রেষ্টত্বের আসরের সেরার খেতাব। এবার সবকিছুই পেলেন এক কোপা আমেরিকা কাপ জিতে। ব্যর্থতার পঞ্চম নয় সফলতার প্রথম খেতাব জিতলেন মেসি সাথে আর্জেন্টিনাও। ব্রাজিলের মাটিতে স্বাগতিকদের ১-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জেতার যে কি আনন্দ সেটি প্রথমবারের মতো পেলেন মেসি। তাতে এক মুহূর্তের মধ্যে দু;খী থেকে এখন তিনি সুখী এক রাজপুত্র।

ব্যর্থ হতে হতে কিভাবে সফল হতে হয় সেটির উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে রইলেন লিও। সব ধরনের ভবিষ্যতবাণী মিথ্যা হয়ে গেল। সাথে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের ৫-০ গোলে জয়েল হুংকারও মিশ গেল ধুলোয়। এখন সবখানেই মেসির জয় জয়কার।

চ্যাম্পিয়ন ট্রফির পাশাপাশি গোল্ডেন বল ও বুট জিতেছেন এলএম টেন। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের ঝকঝকে আর চমচকে পুরস্কারটি যেন এবার পূর্ণতা পেয়েছে। অথচ এই একটি শিরোপা জন্য কতদিনের কত বছরের অপেক্ষা করতে হয়েছে। সর্বকালের সেরা ফুটবলার ডিয়াগো ম্যারাডোনা গত নভেম্বরে পরপারে চলে গেছেন।

অনেকেই এখন তাকে মিস করছেন। তাকে ছাড়া ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনাল ম্যাচ যেন তাই কিছুটা ম্যাড়ম্যাড়ে মনে হয়েছে। তবে প্রিয় গুরুকে উৎস্বর্গ করার জন্যই হয়তো শিরোপা জিতেছে আলবি সেলেস্তারা। পাশাপাশি প্রিয় বন্ধু নেইমার জুনিয়রের সেমিফাইনালে পেরুর বিপক্ষে জেতার পর ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে আর্জেন্টিনাকে চাওয়ার স্বার্থকতা পূরণ হয়েছে। সেটি মেসির।

নেইমার হয়তো চেয়েছিলেন প্রিয় বন্ধু প্রিয় মানুষটিকে ঘরের মাঠে পরাজিত করে শিরোপা জিতবেন। কিন্তু সেটি আর পূরণ হয়নি। ফুটবল ঈশ্বর বোধহয় দূর থেকে মেসির জন্য এক ফাইনাল জেতার মাধ্যমে অনেককিছুই জমিয়ে রেখেছিলেন।

লিওনেল মেসির কাছে এটি শিরোপা জেতা নয়, একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। একটি অপূর্ণতা ঘোচানোর পাশাপাশি নতুন ইতিহাস খেলা। মেসি যে শুধু ক্লাব দলের নয় জাতীয় দলেরও সেটি প্রমাণের একটা মঞ্চও ছিল এবারের কোপা আমেরিকার আসর। প্রতিটা ম্যাচে নিজেকে উজাড় করে দিতে যেন পণ করেই নেমেছিলেন। নয়তো শুরুতে কলম্বিয়া, এরপর আর্জেন্টিনা হয়ে সবশেষ ব্রাজিলে আসর বসার পর শিরোপা জেতার স্বপ্নটা এতটুকু কমেনি।

পুরো আসরে চারটি গোল করার পাশাপাশি পাচঁটি গোলে সহায়তা প্রদান করার যে রেকর্ড সেটি দেশের প্রতি, জাতীয় পতাকার প্রতি দায়বদ্ধতারই প্রমাণ মেলে। ২০১৪ সালে বিশ্বকাপের ফাইনালের পর ঐতিহ্যবাহী মারাকানা যেন ঋণী হয়ে ছিল গেল সাতটি বছর।

অপেক্ষাটা ছিল ১১ জুলাইয়ের। মারাকানা তার দায় দারুণভাবেই শোধ করল। সেখানে ঘরের ছেলে নেইমারকে বঞ্চিত করে হলেও যা প্রয়োজন সেটাই করল। ব্রাজিলের মাটিতে তাই উড়ল আকাশী-সাদা রঙ। একটি শিরোপার জন্য এতটা সময় ধরে অপেক্ষা করতে করতে অনেকেরই ক্লান্দি ধরে গিয়েছিল।

ডিয়াগো ম্যারাডোনার মতো অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। সেই মাপমোচনটা দুঃখী রাজা করলেন রাজপুত্র হয়ে। ফাইনালে শুধু গোলটাই করতে পারেননি মেসি, নয়তো বাকি সবই তার পা দিয়ে হয়েছে। অনেকের মতে, তর্ক স্বাপেক্ষে একটি জায়গায় মেসি পিছিয়ে ছিলেন। কোন মেজর কিংভা আন্তর্জাতিক শিরোপা জিততে না পারার হতাশাটা কাটল অবশেষে।

২০০৭ সালে কোপার ফাইনালে ব্রাজিলেল কাছে ৩-০ গোলে হারের সময় মেসি পরিণত হলেও আজকের মতো ছিলেন না। স্বপ্নভঙ্গের অনুশীলনটা সেই সময় থেকেই শুরু হয়েছিল তার। এরপর ২০১৪ বিশ্বকাপের পর ২০১৫ ও ২০১৬ কোপা আমেরিকার ফাইনালে উঠেছিল আর্জেন্টিনা। তিনটি আসরেই রানার্সআপ দলটির নাম যে আবার লিওনেল মেসির।

বিশেষ করে এই মারাকানায় সাত বছর আগে রানার্সআপ হওয়ার পর বিশ্বকাপ ট্রফির পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া মাথা নিচুঁ করা মেসির ছবিটা এখনো হৃদয়ে বিধে সমর্থকদের। এরপর সর্বশেষ ২০১৬ সালের কোপার ফাইনালে চিলির কাছে হারটা নিউ জার্সি মেটেলিফ ষ্টেডিয়ামও কেদেঁছিল। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৫টা কোপা, ৪টা বিশ্বকাপ আর ৪টা ফাইনালে আক্ষেপ হয়ে আছে।

আন্তর্জাতিক খ্যারিয়ারে ১৭ বছর কাটিয়ে দেওয়া মেসি তাই পেলে বেঁচে থাকার মতো একটা বড় শিরোপা। আর আর্জেন্টিনা সমর্থকরা নতুন করে বলে বেড়াতে পারবেন কোপা আমেরিকার শিরোপা জয়ের কথা। আগের চারটা ফাইনালে যেখানে শিরোপা জিততে না পারার কান্নায় আকাশ ভারি হয়েছিল, এবার সেখানে ছুটেছে হাসির ফোয়ারা। সাথে অনেক কিছু পাওয়ার কান্নাও ছিল।

অনুর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকের স্বর্ণ জিতলেও আন্তর্জাতিক মর্যাদা বিবেচনার এমন মান অনেক নিচে ছিল। এবার আর সেটির কথা বলতে কিংবা শুনতে হবেনা। অনেক বছর ধরেই চলবে কোপা আমেরিকা জয়ের কথা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link