স্টাইলিশ ক্রিকেটার, সমালোচিত নির্বাচক

আমাদের ক্রিকেট ফ্যানবেস কমিউনিটির মধ্যে দুইটা সাধারণ চর্চা খুবই বিদ্যমান। এক, একজনকে বড় করতে গিয়ে অন্য আরেকজনকে ছোট করার উদ্দেশ্যে টেনে আনা। দুই, সমালোচনা করতে গিয়ে একেবারে ভিন্ন দুইটা বিষয়কে গুলিয়ে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলা।

এই দুইটা চর্চাই আমি ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করি, এড়িয়েও চলি। আর আজ কটা লাইন লিখছি ওই দ্বিতীয় চর্চাটাকে কেন্দ্র করে যা বিগত বছরগুলোতে বেশি প্রয়োগ করা হয়েছে মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর ওপর।

সংগত কারণেই নান্নু ভাইয়ের খেলা আমি দেখতে পারিনি। এমনকি এই নামের সাথে পরিচয়টাও আমার ক্রিকেটের মাধ্যমে নয়, প্রাথমিকের গণিত বইয়ের মাধ্যমে। ছোটবেলায় প্রায় প্রতিটা শ্রেণির গণিত বইয়ে একটা না একটা সমস্যা পেতামই যেখানে আকরাম ভাই ও বুলবুল ভাইয়ের সাথে সাথে নান্নু ভাইয়ের নামটা দেখা যেত। তখন ওই দুইজনকে চিনলেও নান্নু ভাইকে চিনতাম না। পরে কৌতূহল মেটাতে গিয়ে তাঁকে ঠিকঠাক চিনতে পারি আমি।

নান্নু ভাই মূলত ব্যাটিং অলরাউন্ডার ছিলেন যিনি ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি স্পিনটাও করতে পারতেন। তবে দলে তাঁর প্রাথমিক ভূমিকাটা ছিল ব্যাটার হিসেবেই। আসলে নান্নু ভাইয়ের ব্যাটসম্যানশিপ নিয়ে বিশদ বলার মত সুযোগ নেই আমার। না তাঁকে সরাসরি কোনোদিন ব্যাট করতে দেখেছি, না তাঁর ব্যাটিংয়ের পর্যাপ্ত হাইলাইটস দেখেছি! কিন্তু আপনি জানেন কি না জানি না, বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসেরই একটা বড় আক্ষেপ বা আফসোস হিসেবে বিবেচনা করা হয় নান্নু ভাইয়ের মতো একজন ব্যাটারের টেস্ট ক্রিকেট খেলতে না পারাটা।

আজ পর্যন্ত নান্নু ভাইয়ের ব্যাটসম্যানশিপ নিয়ে ক্রিকেট পাড়ার কাউকে আমি প্রশ্ন তুলতে দেখিনি বরং সব সময় তাঁর ব্যাটিংয়ের প্রশংসাই শুনেছি। সাবেক ক্রিকেটার থেকে শুরু করে সফল ক্রীড়া সংগঠক কিংবা বর্ষীয়ান ক্রিকেট লিখিয়ে, কাউকেই দেখিনি তাঁর ব্যাটিং নিয়ে কোনোদিন কোনো নেতিবাচক কিছু বলতে। উল্টো তাঁদের মুখে একটা কথা বরাবরই শুনে আসছি। সেটা হলো, ‘মিনহাজুল আবেদীন নান্নু তাঁর সময়ের সবচেয়ে স্টাইলিশ ব্যাটার তো বটেই, বাংলাদেশের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ও স্টাইলিশ ব্যাটার।’

আমার নিজের তেমন কোনো ইনপুট দেওয়ার নেই বলেই তাঁদের কথাগুলা উল্লেখ করলাম। বলছি না এগুলো আপনি একেবারে বেদবাক্যের মত মেনে নেন। কিন্তু এত এত মানুষ, এত এত গুণী ক্রিকেট-ব্যক্তিত্বরা যখন একজন ব্যাটারের প্রশংসায় সর্বদা একবিন্দুতে এসে মিলিত হন, তখন এতটুকু অন্তত বিশ্বাস করাই যায় যে নান্নু ভাইয়ের ব্যাটিংয়ে কিছু একটা তো ছিলই। সে বিশ্বাস আরও জোরালো হয় যখন ’৯৯ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর ব্যাটিং হাইলাইটসগুলা দেখি।

ঠিক এই মুহূর্তে আপনি এ শ্লেষমাখা কথাটা বলে বসতে পারেন, ‘হাহা! যে ব্যাটার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে কখনো ছক্কা পর্যন্ত মারতে পারেননি তাঁর আবার প্রশংসা!’

এই একটা তথ্যকে পুঁজি করে গেল কয়েক বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবিরত ট্রল করা হচ্ছে নান্নু ভাইকে। যদিও ট্রল করায় আমার কোনো আপত্তি নেই যতক্ষণ না তা ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে চলে যায়। এই ট্রল নিয়েও আমার বিশেষ কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমার আপত্তিটা তখনই যখন নির্বাচক নান্নুর সমালোচনা করতে গিয়ে এই ট্রলটা করা হয়।

নির্বাচক নান্নুর সমালোচনা কিংবা ট্রল করার রসদের অভাব নেই। এখন পর্যন্ত তিনি মোটাদাগে ব্যর্থই বলা চলে। তাঁর অধীনে দল নির্বাচনে কোনো সুনির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়া নেই। নেই কোনো ধারাবাহিকতা। শুধু দীর্ঘদিন ধরে দলে (টি-টোয়েন্টি) খেলায় একজনকে টেস্ট দলে অন্তর্ভুক্ত করা কিংবা টেস্ট দলে নেওয়ার মাধ্যমে আরেকজনকে টি-টিয়েন্টির জন্য প্রস্তুত করার মত সিদ্ধান্তগুলো অতীতে তিনিই নিয়েছেন। এসব এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তাছাড়া গেল ৬ বছর ধরে নির্বাচক কমিটিতে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ হয়ে থাকাটা তাঁর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। সমালোচনা বা ট্রলটা আসলে এগুলোকে ঘিরেই হওয়া দরকার। কিন্তু আমাদের ফ্যানবেইসের একটা বড় অংশ এই যৌক্তিক সমালোচনা না করে পড়ে থাকে শুধু ওই ছক্কা না মারতে পারার ব্যাপারটা নিয়ে। এটা খুবই দু:খজনক।

নির্বাচক নান্নু ও খেলোয়াড় নান্নু একদমই ভিন্ন দুইটা সত্তা। এই দুইটাকে এক করে দেখা বা একসাথে গুলিয়ে ফেলাটা চরম বোকামি। তারপরেও মানা যেত যদি দল নির্বাচনে খেলোয়াড়ি জীবনের কোনো ভূমিকা থাকত। ক্রিকেটার নান্নু জীবনে কোনো ছক্কা না মারুক কিংবা হাজারটা ছক্কা মারুক, সেটা দল নির্বাচনে কোনো ভ্যালু অ্যাড করে কি? যদি করত তবে প্রত্যেকটা ক্রিকেট বোর্ডের দল নির্বাচক কমিটিতে কেবল গ্রেটদের দেখা মিলত।

ভেবেছিলাম নান্নু ভাইকে নিয়ে কেবল দুই-এক লাইন লিখব। লিখব, ‘ক্রিকেটার নান্নু যতটা সফল, নির্বাচক নান্নু ঠিক ততটাই ব্যর্থ। তবে তাঁর এই দুইটা ভূমিকাকে এক করে ফেলাটা একদম নির্বোধের মত কাজ।’

কিন্তু পরক্ষণেই মাথায় আসলো, এটা লিখলেই মানুষজন এসে আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর একটাও ছক্কা না মারার ব্যাপারটা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। তখন আবার ইয়া বড় বড় মন্তব্য লিখতে হবে। তার চেয়ে বরং একটা লেখাই লিখে ফেলি না! যে চিন্তার ফসল এই লেখাটা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link