আমার ছোট বেলার সব থেকে কাছের বন্ধু বুবুনের সাথে সব থেকে বেশি ঝগড়া হয়েছে যে বিষয় নিয়ে বা যাকে নিয়ে তিনি আপনি। বুবুন বরাবর ঠাণ্ডা মাথার। আবেগ থাকলেও তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জানতো বুবুন আর আমি বরাবর একটু বেশিই আবেগপ্রবণ। তাই ইচ্ছে করেই ও আমাকে খ্যাপাতো খুব। ওর ছিল কপিল দেব আর আমার ছিলেন আপনি।
পাড়ার উদয়দাদের টিভিতে আপনাকে প্রথম দেখা। এবং প্রেম। হ্যাঁ, ক্রিকেটে আমার প্রথম প্রেম আপনিই ছিলেন। পৃথিবীর কোন প্রেমেরই খুব যুক্তিগ্রাহ্য কোন কারণ বোধহয় থাকে না। ওটা হয়ে যায়। এটাও তেমনই হয়ে গিয়েছিল। পকেটে রাখা লাল রুমালটা একটু বেরিয়ে থাকতো। খুব দুলকি চালে উইকেটের দিকে দৌড়ে এসে আপনার বোলিং।
বুবুন রাগাবার জন্য বলতো, ‘কী বলের ছিরি! এমন পেস যে ব্যাটসম্যান জল খেয়ে রুমালে মুখ মুছে তারপর বলটাকে মারবে!’
এবং আমাকে নিছক খেপাবার জন্যই সেটা বলা। কারণ ও নিজেও জানতো জিমি অমরনাথ বা মহিন্দর অমরনাথ নামের লোকটা ‘ম্যান উইদ দ্য গোল্ডেন আর্ম’। তিরাশির বিশ্বকাপের গায়ে ও কথাটা খোদাই করা আছে। এবং আরো অনেকবারই আপনার ওই মিলিটারি মিডিয়াম পেস অধিনায়ককে ব্রেক থ্রু দিয়েছে।
যে সফর দুটো আপনাকে সাধারণ থেকে অসাধারণের দিকে ঠেলে দিয়েছিল সে সফর দুটো দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি।
১৯৮২-৮৩ মৌসুমে পাকিস্তান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। পাকিস্তানে পাকিস্তান সেই সিরিজে ইমরানের বিধ্বংসী বোলিং এ তিন শূন্য যে সিরিজ জেতে। ইমরান সম্ভবত সিরিজে চল্লিশ উইকেট নিয়েছিলেন এবং ইমরানের সাথে যুগ্ম ভাবে ম্যান অফ দ্য সিরিজ হয়েছিলেন আপনি।
রিচার্ড হ্যাডলির বলে খুলিতে সরু চিড় ধরেছে আপনার, ইমরান আপনাকে পিচে ফেলে দিয়েছেন ; আপনি চেতনা হারিয়েছেন , মার্শালের বলে রক্তাক্ত হয়েছেন আপনি; দাঁত ভেঙে গেছে, টমমোর (জেফ টমসন) বলে চোয়াল এ অসহ্য ব্যাথা। কিন্তু এই সব কিছুই আপনাকে ভয় দেখাতে পারেনি। কারণ ভয় শব্দটা ই জিমি অমরনাথ নামের লোকটার জীবনে ছিল না।
১৯৮২-৮৩ মৌসুমের ব্রিজটাউন টেস্টে যে লোকটা আহত ও অবসৃত হয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, সেই লোকটাই মাথায় বেশ কয়েকটা সেলাই নিয়ে সবাইকে অবাক করে ফিরে এলো। সামনে মাইকেল হোল্ডিং; সেই সময়ের সম্ভবত সব থেকে কাঁপুনি ধরানো ফাস্ট বোলার।
সবাই নিশ্চিত একটা বাউন্সার আসবে এবং মহিন্দর অমরনাথ সভয়ে ‘ডাক’ করবেন বাউন্সার টা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে জিমি আবার হুক করে বলটা বাউন্ডারির বাইরে ফেললেন। এইটাই জিমি অমরনাথ। যে লোকটা পড়ে যাবে, রক্তাক্ত হবে, লড়াইয়ের রিং এর বাইরে ছিটকে যাবে – কিন্তু আবার ফিরে আসবে, আবার পাল্টা মারবে এবং আবার ও হয়তো রক্তাক্ত হবে!
আর এটাই তো আমাদের আম আদমির জীবন তাই না! সেখানে কান্না আছে, রক্তের নোনা স্বাদ আছে, আবার কখনো কখনো জিতে যাওয়াও আছে। সুনীল মনোহর গাভাস্কার বা শচীন রমেশ টেন্ডুলকার যেন আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাছে অনেক অনেক দূরের এক গ্রহ। কিন্তু জিমি অমরনাথ বড় কাছের মানুষ। ওই যে ইমরানের বাউন্সারে পড়ে যাওয়া লোকটা আবার উঠে দাঁড়াবে, আবার গার্ড নেবে।
আর আমরাও গার্ড নেবো। নিজেদের জীবনের যুদ্ধে থেঁতো হতে, হতে, রক্তাক্ত হতে হতে আবার উঠে দাঁড়াবো পাল্টা মারার জন্য। কারণ আমাদের সামনে একটা জিমি অমরনাথ আছে। যার চূড়ান্ত রসবোধ আমাদের হাসায়। যে অবলীলায় নির্বাচকদের ‘ভাঁড়’ বলে দেয়। এবং দিনের শেষে সেই আমাদের লড়াইয়ের পুঁজি হয়ে দাঁড়ায়। তাঁকে বাদ দিতে দিতে আর দলে নিতে নিতে নির্বাচকরাও বোধহয় ক্লান্ত হন। কিন্তু তিনি হন না।
ওই তো একাত্তর পার করা লোকটা গাইছেন – ‘ম্যায় জিন্দেড়ি কা সাথ নিভাতা চালা গায়া, হার ফিকার কো ধুয়ে মে উড়াতা চালা গায়া, বারবাদিয়ো কা শোক মানানা ফুজুল থা, ম্যায় বররবাদিয়ো কা জাশান মানাতা চালা গায়া ….’
ভাল থাকবেন জিমি। আপনি আমার প্রথম প্রেম ক্রিকেটের। ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।