আউটসাইডার, ফিনিশার নাকি ম্যাজিশিয়ান?

বলিউডের কল্যানে তাঁর উত্থানের গল্পটা সবারই জানা। তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের প্রচলিত কাঠামোর কেউ নন। না সমৃদ্ধ কোনো ঘরোয়া রেকর্ড, না ছিল বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে প্রতিভার বিচ্ছুরণ। তিনি আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন বহিরাগত। জাতীয় দল নির্বাচনে সেদিন অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি ‘এম এস ধোনি’ শব্দটা উচ্চারণ না করলে হয়তো এই প্রকাণ্ড ক্রিকেটারের নামটা ক্রিকেট বিশ্বের কাছে অপরিচিতই থেকে যেত।

বাংলাদেশের বিপক্ষে চট্টগ্রামে কোনো রানের খাতা খোলার আগেই খালেদ মাসুদ পাইলট তাঁকে রান আউট করে বিদায় করেছিলেন ২০০৪ সালে। সেটাই অভিষেক। কী বিচিত্র দর্শন যুবক! বড় চুল, লা রং। বাইক পাগল। কখনো মাঠের মধ্যেই বাইক চালিয়ে ফেলেন পারলে। কেমন বখাটে একটা স্বভাব। আর কি উদ্ভট ব্যাটিং টেকনিক। এই ছেলে বেশিদিন টিকবে না – রায় দিয়ে ফেলেছিল ভারতীয় মিডিয়া। সায় দিয়েছিল ক্রিকেট বোদ্ধারাও!

‘মাহি’ অবশ্য সেসবে কখনো পাত্তা দেননি খুব। পরের বছরই ভাইজাগে পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যাটিং প্রমোশন পেয়ে করলেন সেঞ্চুরি। একই বছর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে যখন ৯১ রানে পাঁচ উইকেট পড়লো ভারতের, তখন জিম্বাবুয়ের মত দলের ২৫৫ রানটাকেও মনে হচ্ছিল দূর আকাশের তারা। ধোনি সেখানে দাঁড়িয়ে ৬৩ বলে ৬৭ রানের অপরাজিত ইনিংস খেললেন। বোঝা গেল, কেবল ব্যাটিং জানা উইকেটরক্ষক আসেননি, এসেছেন একজন ফিনিশার।

সেখান থেকে তিনি কালক্রমে সর্বজয়ী অধিনায়ক বনেছেন। তিনি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছেন নবীন এক দল নিয়ে, ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ জিতেছেন, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছেন, টেস্ট র‌্যাংকিংয়ের এক নম্বরে উঠেছেন। মানে একজন অধিনায়কের পক্ষে যা যা অর্জন করা সম্ভব – তার সবটাই তিনি পেয়েছেন। হয়ে উঠেছেন আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এক ম্যাচ ফিনিশার। ভুতুড়ে ও কখনো কখনো কুৎসিত দেখতে এক ব্যাটিং স্টান্ট দিয়ে ‘মাহি’ ছুঁয়েছেন আকাশ।

‘রাঁচি’র ছেলে তিনি। আগে ডাকনাম ছিল ‘পাগলা গারদ’-এর শহর। এখন স্রেফ ‘মাহি’র শহর। তার পরও তাঁর শরীর থেকে কখনো ‘বহিরাগত’ তকমাটা মুছে যায়নি। কখনো বলা হয়েছে ভাগ্য, কখনো বা জুয়া। কোনো কোনো নিন্দুক বলেছেন, ঘরের মাটির সহায়তা। কিন্তু, তাঁর অদম্য সাহসটা কারো চোখে পড়েনি। পড়বে কি করে, ভদ্রলোকের খেলাটায় তিনি কখনোই ঠিক ‘ভদ্রলোক’ ছিলেন না। তিনি বরাবরই ঠোঁট কাটা। রাফ অ্যান্ড টাফ!

২০১১ মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলার আগে ‘চাপ’ বিষয়ক প্রশ্নের জবাবের তিনি শুরুটা করেছিলেন, ‘এহ ভাই! আপ ক্যায়া প্রেশার কুকার লেকে ঘুমতে হো?’ বুঝুন অবস্থা! এই লোক কি করে মিডিয়ার প্রিয় মুখ হবেন।

তিনি সেটা হতে পারেননি। হতে চান ও নি। মিডিয়া তাই বলে, ভাগ্যের সহায়তায় ভারতকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন ধোনি। কেউ ধোনির ‘ম্যাজিক’ টা দেখেন না। কেন তিনি শেষ ওভারটা যোগিন্দর শর্মা নামের অখ্যাত এক তরুণকে শেষ ওভারটা করতে দিয়েছিলেন? কি ছিল ধোনির ভাবনা? – ধোনি যে ম্যাজিশিয়ান সেই স্বীকৃতি তাঁকে কেউ দেয়নি।

কিংবা ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল। সবাই বলে দেশের মাটির সহায়তা পেয়ে জিতেছে ভারত। কিন্তু, নিন্দুকেরা দেখে না সেবারই যে কোনো স্বাগতিক দলের হাতে উঠেছিল বিশ্বকাপের ট্রফি। কিংবা দেখে না, কতটা সুকৌশলে সৌরভ গাঙ্গুলি-রাহুল দ্রাবিড়দের মত মহা তারকার বিদায়ের আস্তে আস্তে করে তরুণদের ওপর ভরসা বাড়িয়েছেন ধোনি।

আবার সেবারের সেই বিখ্যাত ফাইনাল ম্যাচের কথাই ধরা যাক। কি বুঝে তিনি ব্যাট করতে নেমেছিলেন বিশ্বকাপের তারকা যুবরাজ সিংয়ের আগে! সিদ্ধান্তটা ‘ব্যাকফায়ার’ করলে অধিনায়কত্ব তো বটেই, ক্যারিয়ারটাও ধসে যেতে পারতো। কিন্তু, ধোনি অন্য ধাতুর গড়া। মুম্বাইয়ের বন্দে মাতরাম ধ্বনি, ভুভুজেলার চিৎকারের মাঝে তিনি ম্যাচ জেতানো এক ইনিংস খেলেছেন।

নুয়ান কুলাসেকারার ফুল লেংথ ডেলিভারিটাকে যখন লং অনের ওপর দিয়ে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিলেন, তখন ধারাভাষ্যকক্ষে রবি শাস্ত্রী চিৎকার করলেন, ‘ধোনি ফিনিশেশ অফ ইন স্টাইল!’ সেই শাস্ত্রী যিনি নিজেও বিশ্বাস করতেন না, যে ধোনি পারবেন।

সেই বিশ্বকাপ ফাইনালেই সতীর্থদের কাঁধে চড়ে ল্যাপ অব অনার পেলেন শচিন টেন্ডুলকার, ভারতের ক্রিকেট ঈশ্বর। ধোনি থাকলেন সেই ল্যাপ অব অনারের সবার পেছনে। এই ঈশ্বরের সম্মানটা তিনিও পেতে পারতেন।

পাননি, আবেগে ধোনির সেদিন চোখ ভেজেনি। আসলে তিনি এসব আবেগ, চাপ – সব কিছুর অনেক অনেক উর্ধ্বে। নিজের দায়িত্বটুকু পালন করেছেন, তাই তো ঠোঁটে সব সময়ই থাকতো তৃপ্তির হাসি।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link