নেতা তিনি, ফুটবলারও তিনি

বঙ্গবন্ধু মানে তো এক পর্বতপ্রমাণ কাহিনী। অসংখ্য ঘটনা, অসংখ্য ত্যাগ, অসংখ্য যুদ্ধ নিয়ে গড়ে ওঠা এক অসীম গ্রন্থ। বঙ্গবন্ধুর হিমালয়সম এই প্রতিভার পিছনে আড়াল হয়েছে তাঁর নানাবিধ প্রতিভা। সেগুলোর মধ্যে খেলোয়াড় বঙ্গবন্ধুও একটি।

অফিসার্স ক্লাব তাঁদের দলে টাকা দিয়ে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেরা ফুটবলারদের নিয়ে এসেছে।

জেলার সামান্য একটা স্কুল দলের সাথে ফুটবল ম্যাচ। তবুও এই ম্যাচ দেখতে জেলার আনাচে-কানাচে থেকে মানুষ এসে ভিড় করেছে। ক্লাবের সেক্রেটারি স্বয়ং খেলছেন। তবে এসবের কিছুই এই এতো দর্শকের আগ্রহের ব্যাপার নয়। যেই স্কুলের সাথে অফিসার্স ক্লাব খেলবে সেই স্কুলের অধিনায়ক আবার অফিসার্স সেক্রেটারির ছেলে। মাঠে পিতা-পুত্রের এই লড়াই দেখতেই মূলত এমন উপচে পড়া ভিড়।

নামী-দামী ফুটবলারদের নিয়ে গড়া অফিসার্স ক্লাবকে হারিয়ে দিয়েছিল মিশন স্কুলের ছেলেরা। মিশন স্কুলের এই দলটাকে নিজ হাতে গড়েছিলেন তাঁদের অধিনায়ক। জেলার ভালো ফুটবলারদের খুঁজে এনে মিশন স্কুলে ভর্তি করাতেন। তাঁদের বিনামূল্যে পড়ার ব্যবস্থা করে দিতেন। তারপর নিজের নিখুঁত নেতৃত্বে দলটাকে বিভিন্ন শিরোপা জিতিয়ে নিয়ে আসতেন।

কে এই অসাধারণ নেতা?

খেলোয়াড়দের সাথে হাত মেলাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু

অসাধারণ নেতা তো একজন। হ্যা, তিনি বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের শ্রেষ্ঠতম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হ্যা, গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের সেই অধিনায়ক ছিলেন বাংলায় জন্ম নেয়া সবচেয়ে ক্যারিশম্যাটিক পুরুষ, শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু মানে তো এক পর্বতপ্রমাণ কাহিনী। অসংখ্য ঘটনা, অসংখ্য ত্যাগ, অসংখ্য যুদ্ধ নিয়ে গড়ে ওঠা এক অসীম গ্রন্থ। বঙ্গবন্ধুর হিমালয়সম এই প্রতিভার পিছনে আড়াল হয়েছে তাঁর নানাবিধ প্রতিভা। সেগুলোর মধ্যে খেলোয়াড় বঙ্গবন্ধুও একটি।

ফুটবলার হিসেবেও অনন্য ছিলেন এই মানুষটি। মিশন স্কুলের হয়ে তাঁর ফুটবল যাত্রা শুরু হয়। তারপর গোপালগঞ্জ জেলা দলের হয়ে খেলা শুরু করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে গোপালগঞ্জে ফুটবল খেলার স্মৃতিচারণ করেছেন। বাবার বিপক্ষে খেলার সেই সময়ের কথা বলেছেন তিনি, ‘আমার আব্বাও ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আব্বার টিম আর আমার টিমের যখন খেলা হতো, তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। আমাদের স্কুল টিম খুব ভালো ছিল। মহকুমায় যারা ভালো খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম। ১৯৪০ সালে আব্বার টিমকে আমার স্কুল টিম প্রায় সকল খেলায় পরাজিত করল। অফিসার্স ক্লাবের টাকার অভাব ছিল না। খেলোয়াড়দের বাইরে থেকে আনত। সবাই নামকরা খেলোয়াড়।’

খেলা দেখছেন বঙ্গবন্ধু, পাশে শেখ রাসেল

এরপর ঢাকায় এসে রীতিমতো সর্বোচ্চ স্তরের ফুটবল খেলেছেন। সেই সময় ঢাকার চকবাজারের বাসিন্দারা প্রতিষ্ঠা করেন ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। ক্লাবটি অল্প কিছু দিনের মধ্যেই একটি শক্তিশালী ফুটবল দল গঠন করে ফেলে। এবার এই দলটির অধিনায়ক হন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪০ সাল থেকে টানা ৮ বছর দলটির নেতৃত্ব দেন তিনি। সেই সময় ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের স্ট্রাইকার ছিলেন তিনি।

পরবর্তীতে রাজনীতিতে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে পড়ায় আর ফুটবল খেলা হয়নি তাঁর। তবে তাঁর হাতে গড়ে তোলা দলটা ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে মোট সাত বার ঢাকা ফুটবল লিগের চ্যাম্পিয়ন হয়। এর মধ্যে ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ এই চার বছর টানা ঢাকা লিগের শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়ে দলটি।

বঙ্গবন্ধু তাঁর আসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থেও ফুটবল নিয়ে তাঁর ভালবাসার কথা স্মৃতিচারণ করেন। ফুটবল ছাড়াও হাডুডু খেলতেও ভীষণ ভালবাসতেন তিনি। এমনকি হাডুডু খেলতে গোপালগঞ্জ থেকে বরিশাল, যশোরেও চলে যেতেন। পরবর্তীকালে দেশ স্বাধীন হবার পর হাডুডুরই আরেকটি সংস্করণ কাবাডিকে জাতীয় খেলা করা হয়।

১৯৭২ সালে শেখ মুজিব সরকার গঠন করার সাথেসাথেই দেশের ক্রীড়াঙ্গনে মনোযোগ দেন তিনি। সেই সময়ের যুদ্ধ-বিধবস্ত দেশ সামাল দিতে ব্যস্ত একজন রাষ্টপ্রধান একবারের জন্যেও ভুলে যাননি দেশের তরুণ প্রজন্মের কথা। তরুণ প্রজন্ম যেনো খেলাধুলার সবরকম সুযোগ সুবিধা পায় সেদিকে সবসময় নজর রেখেছেন। সেই সময় ক্রিকেট সামগ্রীর কর ছিল ১৩০ শতাংশ। এই কথা শুনে শেখ মুজিব তখন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে এই কর বাতিল করার জন্য নির্দেশ দেন।

খেলোয়াড়দের মাঝে বঙ্গবন্ধু

১৯৭২ সালে গঠিত হয় জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। এছাড়াও সেই সময়ে তিনি প্রায় সকল ক্রীড়া সংগঠন তৈরি করেন। গঠিত হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের মত সংগঠন গুলো। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ফিফার সদস্যপদও লাভ করে।

সেই সময়ের ফুটবল মাঠের মেগাস্টার কাজী সালাউদ্দিন ছিলেন বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বর্তমানে বাফুফের এই প্রেসিডেন্ট কালের কন্ঠকে এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘দেশে বা বিদেশে যেখানেই আমরা খেলতে গিয়েছি, বঙ্গবন্ধু খোঁজখবর নিয়েছেন আমাদের। আমরা একবার আইএফএ শিল্ড খেলতে কলকাতা গিয়েছিলাম। শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের ফোনে উৎসাহ দিয়ে জানান, শিরোপা জিতলে খেলোয়াড়দের বিমানবন্দর থেকে নিয়ে পুরো ঢাকা শহর ঘোরানো হবে ঘোড়ার গাড়িতে। ১৯৭২ সালে কলকাতার মোহনবাগান আর ১৯৭৩ সালে রাশিয়ার মিন্সক ডায়নামো ক্লাব খেলতে আসে ঢাকায়। হাজারো কাজ বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু দুটি ম্যাচই উপভোগ করেছেন গ্যালারিতে বসে। ফুটবলে বা অন্য কোনো খেলায় ভালো করলে নতুন স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশকে যে সবাই সমীহ করবে, এটা জানতেন তিনি। সব সময় বলতেন খেলা আর রাজনীতিকে আলাদা রাখতে। এ জন্যই শেখ কামাল যখন আবাহনী ক্লাব গড়ে তুলছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধুর কড়া নির্দেশ, ‘রাজনীতিবিদদের ক্লাবের সঙ্গে জড়িত রাখবে না।’

দেশের ক্রীড়াবিদ ও তাঁদের পরিবারকে সাহায্য করার জন্য ১৯৭৪ সালে গঠিত হয় ‘বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন’। এই ফাউন্ডেশনটি এখনো তাঁদের কার্যক্রম স্বগৌরবে চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বোপরি একটি রাষ্ট্রের সর্বকালের সেরা নেতা, যিনি দেশটাকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন তিনিই আবার মাঠে ছিলেন একজন সাধারন ফুটবলার কিংবা হাডুডু খেলোয়াড়। তিনিই ছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় অভিভাবক। তিনি ছিলেন গোটা একটা জাতির পিতা, বন্ধু, একজন বঙ্গবন্ধু।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...