মাশরাফি বিন মুর্তজাকে জিজ্ঞেস করুন, বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটারদের আদর্শ হওয়া উচিত কার? মাশরাফি না ভেবেই বলবেন, মুশফিক।
কেবল মাশরাফি নন, বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্রিকেটার মনে করেন একজন তরুণ ক্রিকেটারের জন্য আদর্শ হওয়ার সব গুনাবলী ধারণ করেন আমাদের মুশফিকুর রহিম। এই খেলাটার প্রতি এতো ভালোবাসা, এতো পরিশ্রম, এতো কমিটমেন্ট, নিজের প্রতি এতো তীব্র প্রতীজ্ঞা এবং খেলাটিতে এতো ডুবে যাওয়ার বৈশিষ্ট্য আর কারো মধ্যে নেই।
সকালে জড় হতে পারে, বিকেলে ভূমিকম্প হতে পারে, তার শরীরে জ্বর থাকতে পারে; কিন্তু মুশফিক কখনো অনুশীলন আর পরিশ্রমের সাথে আপোষ করেন না। দুনিয়ার সব ক্রিকেটারের ছুটি থাকতে পারে; মুশফিক তার ব্যাটকে কখনো অলস বসে থাকতে দেন না। ক্রিকেটের শত চাপ তাঁকে পিষ্ট করতে পারে, পরিবার তাঁর কাছে অনেক সময় দাবি করতে পারে; কিন্তু মুশফিক তার পড়াশোনার সাথে আপোষ করেন না।
এমন খেলোয়াড় আদর্শ হবেন না, কে হবেন!
সেই মুশফিককে আজ কাঠগড়ায় দাড়াতে হচ্ছে একটু অশোভন কাজের জন্য। নিশ্চিত করেই বলা যায়, ম্যাচে অতিরিক্ত মনোযোগী ও আবেগী হয়ে পড়ার ফলে রাগের মাথায় তিনি নাসুম আহমেদের সাথে কান্ডটা করে ফেলেছেন। সাথে সাথেই নিজে আবার তাকে স্বান্তনা দিয়ে নিয়েছেন।
ব্যাপারটা তো বড় ভাইয়ের শাসন বই কিছু নয়।
শাসন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। শাসন আমাদের আচরণ, কাজে ভারসাম্যটা বজায় রাখে। আমরা যখন ভুল করি, বাবা-মা বা পরিবারের অন্যান্য অভিভাবকরা শাসন করেন বা বুঝিয়ে বলেন। তবে সেটা সবার সামনে হলে, বোধগম্যতা দূরে সরে গিয়ে অপমানটাই গায়ে লাগে বেশী। শাসনের কার্যকারিতা কমে যায়।
ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ম্যাচ যখন চরমে উঠত, প্রতিপক্ষের টেনশন, একে অন্যের ঝগড়া নিজেদের মনে আনন্দ দিত, প্রতিপক্ষের রাগ দেখানোর মানে হচ্ছে, তাঁদের নিজেদের আত্মবিশ্বাসে চির ধরেছে, নিজেদের বোঝাপড়ায় গোলমাল হচ্ছে। ক্রিকেট বা ফুটবলের মত দলীয় খেলায় যা আত্মহূতির সমান।
একটা সময়, বাংলাদেশের ক্রিকেট স্কিল ভাল ছিল না। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সেই ভক্তরা খুশি হয়ে উঠত। জয়ের আশাটা স্বপ্ন থেকে বাস্তব হতো কম।
এখন আমাদের দলে বিশ্বমানের ক্রিকেটার আছেন, শুধু মুখেমুখে না, রীতিমত র্যাংকিংও দাপাচ্ছেন। আমরা প্রতিম্যাচেই জয় আশা করি, যা পাঁচ বছর আগেও ছিল না। এই উন্নতির কাণ্ডারি বর্তমান ক্রিকেটাররাই।
এখন আমরা বিশ্বসেরা হবার স্বপ্ন দেখি। বিশ্বকাপ জেতা, এক নম্বার দল হবার আশা করি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, শুধু মাঠের খেলা বাদেও অনেক কিছু উন্নতি করা বাকি রয়ে গেছে।
জন রাইট ভারতের অন্যতম সেরা একজন কোচ। কিছুটা নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। একবার শেবাগ গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে এগ্রেসিভ খেলতে গিয়ে ডাক মেরে আসেন। কোচ খেপে গিয়ে কলার চেপে দেয়ালে ঠেসে ধরেছিলেন! বেশ চমকপ্রদ ঘটনা।
৯৬-এ শচীনের ভারত একবার ১২০ রানের জবাবে মাত্র ৯৬ রানে অলাআউট হয়। অধিনায়ক শচীন কিছুটা খেপে উঠেন প্লেয়ারদের উপর। সৌরভকে তো রাগ করে দল থেকে বের করে দেবার কথাও বলে বসেছিলেন! নিউজপেপারে কড়চা হবার মত যথেষ্ট বড় খবর।
পন্টিং নাকি একবার ওয়ার্নের ড্রিংস বন্ধ করে দেবার হুমকি দিয়েছিলেন, তাঁর মনে হচ্ছিল ফিল্ডিংয়ে ঢিল দিচ্ছেন ওয়ার্ন! এটাও মিডিয়া শুনতে পারেনি, ঘটনার বহুবছর পর মজারছলে ওয়ার্ন না বললে।
অথচ মিডিয়া দূরে থাক, বহুবছর পর সাবেক হয়ে যাওয়া প্লেয়াররা এসব ঘটনা বিভিন্ন জায়গায় না বললে হয়তো বাইরেই আসত না!
এখানেই বিশ্বসেরা আর মিডিওকার দলের পার্থক্য বোধহয় ঠিক হয়ে যায়!
বহু বোদ্ধাই তো বহুবার বলেছেন, ক্রিকেট যত না স্কিল তারচেয়েও বেশি মানসিকতার খেলা। আপনি মানসিকভাবে যত দৃঢ়, এই খেলায় আপনি তত এগিয়ে যাবেন।
অনেকের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম সামর্থ্য নিয়ে শুরু করা ধোনি, রানাতুঙ্গারা এগিয়ে গেছেন মানসিকতার জোরেই। আমাদের দেশের ক্রিকেটারদের এই মানসিকতার ব্যাপারটা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
মুশফিক ভাই, একজন মাশরাফিকে আইডল মেনে পেসারদের একটা প্রজন্মই গড়ে উঠেছে। আপনার যে আরও বড় আদর্শ স্থাপনের কথা ছিল। আপনার মত একাডেমিক সাফল্য এদেশের আর কোন ক্রিকেটারের ছিল কিনা তা আমার জানা নেই, তাও খেলা চলাকালীন অবস্থায়।
আবার পড়াশোনাকে সঙ্গে নিয়েই ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করা মৌলিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন আপনি। আপনার কথা উঠলে সবার সম্ভ্রম জেগে উঠার কথা। বাবা মায়েদের বলার কথা, ক্রিকেটার হলে মুশফিকের মত হবি। আপনার ব্যক্তিত্ব অনুকরণীয় হবার কথা ছিল।
আপনি অবশ্যই আদর্শ। আর সে জন্যই বাকীদের চেয়ে আপনার চাপটা একটু বেশি। অন্যরা যে আচরণ করলে মানিয়ে যায়, আপনি সেটা করলে চোখে লাগে। কারণ, আপনি যে আমাদের কাছে মিস্টার পারফেক্ট।
মানুষ মাত্রই ভুল করে।
মাঠে এরকম করলে রাগ লাগতেই পারে, প্লেয়ারকে বকা দিতেই পারেন। আপনি দলের অধিনায়ক, দলের মোস্ট সিনিয়র, সিরিয়াস ভুল আপনার চোখেই বেশি খারাপ লাগবে, ভুল ধরাবেন। তবে তা মাঝমাঠে না হয়ে ড্রেসিংরুমে হলে ভাল হত না?
যেই ছেলেটা সবার সামনে এরকমভাবে অধিনায়কের কাছে অপদস্ত হলো, ফাইনালে একই রকম পরিস্থিতিতে তার হাত যে এরচেয়ে বেশি কাঁপবে না তা কি বলতে পারেন?
আপনি অবশ্যই মাঠে মেজাজ হারানো প্রথম ক্রিকেটার নন, আপনার চেয়েও বাজে ছিল অনেকেই। কিন্তু আপনি যে আমাদের ডিপেন্ডেবল মুশফিক! আপনার প্রতি যে সবার অনেক প্রত্যাশা!
সাফল্যের দিনবদলের সাথে মানসিকতার বদলের শুরুটাও একই কারিগরের কাছ থেকে আসুক, এইতো চাই।
এইরকম ছবি যে মনে পীড়া হয়ে থাকে বহুদিন!
আসুন, এই ছবিটা এখানেই মুছে ফেলি। আমাদের হৃদয়ে গাথা থাক কেবলই পরিশ্রমি, নিবেদিত ও প্রতীজ্ঞাবদ্ধ মুশফিকের ছবি। আপনি নিজেকে সব সময়ের মতো পারফেক্টই রাখুন, মুশফিক ভাই।