আমার বন্ধু জিসান

আমার বন্ধু জিসান। মাঠে ওর যেকোনো স্পট কিক হয় লক্ষ্যভেদ করত, না হয় বারে লাগত। ওর ড্রিবলিং আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। ডি বক্সে কখনও কখনও তাঁকে আমার ব্রাজিলের রোনালদো বলে মনে হত।

আমার বন্ধু জিসান। মাঠে ওর যেকোনো স্পট কিক হয় লক্ষ্যভেদ করত, না হয় বারে লাগত। ওর ড্রিবলিং আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। ডি বক্সে কখনও কখনও তাঁকে আমার ব্রাজিলের রোনালদো বলে মনে হত।

চোখের সামনে এই মানের খেলোয়াড় আমি খুবই কমই দেখেছি। হলফ করে বলতে পারি, স্কুল মাঠে আমার দেখা এরকম চরিত্র কেবল জিসান একা নয়। আরও কমপক্ষে ২০ কি ৩০ জন ছিল। আমি প্রিভিলেজড। আমার স্কুলে ফুটবল খেলার লায়েক কমপক্ষে ৭-৮টা মাঠ ছিল।

কিন্তু, সেই চরিত্রগুলো কোথায় ? জিসান এখন জার্মানিতে। বাকিদের কেউ কর্পোরেট চাকরি করছে, কেউ ব্যাংকার, কেউ অস্ট্রেলিয়ায়, কেউ বিসিএস ক্যাডার, কেউ বা ব্যবসায়ী। কেউ ফুটবলকে ভবিষ্যৎ মানতে পারেনি, আমাদের ওই সময়ে কেউ ভাবতেও পারেনি।

কেন আমরা ফুটবলকে ভবিষ্যৎ মানতে পারি না? স্পষ্ট উত্তর, ফুটবল আমাদের কোনো সুনিশ্চিত ক্যারিয়ারের নিশ্চয়তা দেয় না। সংসার চালানো, নিদেনপক্ষে পেট চালানোর নিশ্চয়তা দেয় না ফুটবল ক্যারিয়ার।

এই যে মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরেছে, দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবলে একচ্ছত্র আধিপত্য নিশ্চিত করেছে, তাঁদের ক্ষেত্রে অবস্থার পরিবর্তন যে হবে সেই গ্যারান্টি কে দিচ্ছে?

তিন মাস বেতন না হলেও ছাদ খোলা বাস প্রস্তুত। ভবিষ্যতে কি লেখা আছে, নতুন কোচ কে হবেন, মানসম্পন্ন হবেন কি না? সেসব প্রশ্নের উত্তর না পেলেও বলা যায়, উৎসবের মঞ্চ প্রস্তুত। ক্ষণিকের এই উৎসবই কি সাঙ্গ হবে?

দায় এখানে সব পক্ষের আছে। বোর্ড সচেতন নয়, ব্র্যান্ডগুলোর আগ্রহ এখনও তুলনামূলক কম। মিডিয়া কাভারেজও নেই। অসংখ্য ‘নেই’-এর মাঝেই এই সাফল্য এসেছে। টানা দুইবার দক্ষিণ এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই জিতে নিয়েছে, এশিয়ান মঞ্চে প্রতিযোগিতার সুযোগ পাচ্ছে নিয়মিত।

সব কিছু মেনে নিলাম। এবার বলেন, বাংলাদেশের একজন কিশোর বা কিশোরী, মানে একালের জিসান যারা – তারা কি এরপরও ফুটবলের স্বপ্ন দেখতে পারবেন? কেন তাঁর জার্মানিতে না গিয়ে দেশের ফুটবলের পেছনে নিজেদের নিবেদন করবেন? আমি অন্তত কোনো কারণ দেখি না।

সব জায়গায় তো সাকিব আল হাসানের উদাহরণই দেই। আবারও দিচ্ছি। এখনকার কিশোর বা শিশু যারা, তাঁরা যদি খেলাধুলায় আগ্রহী হন, তাহলে তাঁরা কোন জীবন দেখে বেশি আগ্রহী হবেন? সাকিব আল হাসানের নাকি সাবিনা খাতুনের? সাকিব নিজেও তো ছোটবেলায় ফুটবলারই হতে চাইতেন, পরে বাস্তবতা বুঝে ক্রিকেটে সরে এসেছেন।

জীবনের এই বাস্তবতা, বা মোটা অংকে পেশাদার জীবনের এই বাস্তবতা খুবই ভযংকর। এখানে ক্ষণিকের সাফল্য বা স্টারডম কোনো কাজে আসে না। আজ সাফল্য আছে, সবাই পাশে আছে। মিডিয়া গুণ গাইছে, বোর্ড সংবর্ধনা দিচ্ছে। কিন্তু, এসবে চিড়ে বেশিদিন ভিজবে না। এর জন্য দরকার ক্যারিয়ারের নিশ্চয়তা।

নিশ্চয়তার জন্য প্রথমত লাগবে সাফল্য। শুধু দক্ষিণ এশিয়ান মঞ্চে না, এশিয়া বা বৈশ্বিক মঞ্চে। এই যে দলটা এখন খেলছে, এদের একজন যদি ইউরোপের মঞ্চে সুযোগ পান কোনো ক্লাবে – তাহলে বদলে যেতে পারে দেশের ফুটবলের ভাগ্য। তখন স্পন্সর বা ব্র্যান্ড – কোনো কিছুরই অভাব হবে না।

১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয় দিয়ে বদলে গিয়েছিল দেশের ক্রিকেটের ভাগ্য। সেদিন থেকে ফুটবলের জনপ্রিয়তাও নিয়ে ফেলেছিল ক্রিকেট। ফুটবলের এখন হারানো রূপে প্রত্যাবর্তন কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। তাহলে আমার বন্ধু জিসানদের স্বপ্ন ভুলে জার্মানিতে থিতু হতে হবে না।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link