ছক্কা নাঈম, অফ স্পিনার, টেস্ট ব্যাটসম্যান, একজন অল-রাউন্ডার।
একসাথে অনেকগুলো বিশেষণই এভাবে মনে আসে ক্রিকেটার নাঈম ইসলামের নাম মাথায় আসলে। ব্যাট হাতে যিনি তিন বলে তিন ছক্কা হাঁকিয়ে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিলেন। আবার বিভিন্ন সময় খেলেছেন মাথা ঠান্ডা রাখা লম্বা ইনিংস। সেই খেলোয়াড়ই এনে দিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়।
সেই নাঈম ইসলামই যেনো হারিয়ে গেলেন ক্রিকেট থেকে। নিজের খেলা শেষ টেস্ট সিরিজেও সেঞ্চুরি ছিলো। অথচ সেই নাঈম আজ কোনো খবরেই নেই।
ঘরের মাঠে সিরিজে কিউইদের দ্বিতীয় বাংলাওয়াশে তার ছিলো অসামান্য অবদান ব্যাট হাতে। টিম সাউদি, কাইল মিলস, কোরি অ্যান্ডারসন ও জিমি নিশামদের তুলোধনা করে যিনি হয়েছিলেন সিরিজের সর্বাধিক রান সংগ্রহকারী।
দেশের ক্রিকেট তখন আইসিএলের থাবায় জর্জরিত। আফতাব, অলক, নাফিসরা দেশের ক্রিকেটকে পঙ্গু করে দিয়ে, ভারতে পাড়ি জমান বিদ্রোহী লিগ আইসিএলে অংশ নিতে। জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্যদের আকষ্মিক প্রস্থান হৃদয়ভঙ্গ করছিলো দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের। দলের নিয়মিত সদস্যরা দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এক প্রকার ভেঙেই দিয়েছিলেন জাতীয় দলের মেরুদণ্ড। ভাঙাচোরা এক দল নিয়েই আশরাফুলের নেতৃত্বে প্রথমবারের মত নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজে মাঠে নামে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচেই অভিষেক মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ও পার্ট-টাইম অফ স্পিনার নাঈম ইসলামের।
জাতীয় দলে অভিষেক ২০০৮ সালে হলেও। ক্রিকেটের সাথে নাঈম ইসলামের পথচলা অনেক দিনের। ২০০৪ সালে ঘরের মাঠে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, আফতাব আহমেদ ও নাফিস ইকবালদের সাথেই খেলেছেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। ব্যাট হাতে সেবার ৮ ম্যাচে ২০৬ রান করেন নাঈম ইসলাম। নাফিস ইকবালের সাথে ওপেনিংয়ে দারুণ সঙ্গ দিয়েছিলেন সে বিশ্বকাপে।
২০০৪ সালের সেই যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা তিন জনের একজন ছিলেন নাঈম ইসলাম। একই বছর বাংলাদেশ একাডেমীর হয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে অসাধারণ ব্যাটিং করেন নাঈম। ৬ ম্যাচে প্রায় ৪৪ গড়ে ৩০৪ রান করেন নাঈম ইসলাম।
জাতীয় দলে একজন তরুণ প্রতিভাবান হিসেবে তার আবির্ভাব ঘটে। নিয়মিত কিছু ক্রিকেটারের অভাব ব্যাটিং ও বোলিং উভয় দিক দিয়েই দূর করতে দলে ডাক পান নাঈম ইসলাম। নাঈম ইসলামের আন্তর্জাতিক অভিষেকেই অধিনায়কত্বের অভিষেক ঘটে মোহাম্মদ আশরাফুলের। নিয়মিত ক্রিকেটারদের অনুপস্থিতিতেও নিউজিল্যান্ডকে ওডিআইতে হারিয়ে প্রথমবারের মত হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে বাংলাদেশ।
অভিষেকে ব্যাটিং করার সুযোগ হয়নি নাঈমের। পরের ম্যাচে ব্যাটিংয়ে নামলে আশরাফুলের সাথে ভুল-বোঝাবুঝি তে কোনো বল মোকাবেলা না করেই রান আউট হয়ে ফিরে যান সাজঘরে। সিরিজের শেষ ম্যাচে ১০৬ বলে ৪৬ রান করে অপরাজিত থাকেন নাঈম। ধীরগতির ইনিংস হলেও সেদিন বাকি ব্যাটসম্যানদের আসা-যাওয়ার মিছিলে নাঈমের ইনিংস টাই কমিয়েছিলো হারের ব্যবধান। ব্যাট হাতে নিজের পারদর্শিতা বা দীর্ঘক্ষণ উইকেটে টিকে থাকার ক্ষমতা প্রমাণ করেছিলেন সেদিন নাঈম।
নাঈমের অভিষেক সিরিজে প্রথমবারের মত নিউজিল্যান্ড কে সিরিজ হারানোর সম্ভাবনা তৈরি করেও ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। এমনকি বল হাতে সেই সিরিজ থেকে তিন উইকেট সংগ্রহ করে নাঈমের প্রচেষ্টা ছিলো অসাধারণ। নতুন মুখ হিসেবে দলে পছন্দের পজিশনের ব্যাটিং করা হচ্ছিলো না নাঈমের প্রথমদিকে৷ পুরো ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়েই নাঈম ব্যাটিং করেছে লোয়ার অর্ডারে অর্থ্যাৎ ৮ নম্বরে। এখনকার সময়ে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের চেয়েও নীচে ব্যাটিং করতো জাতীয় দলে নাঈম। ধীরে ধীরে দলে তার ছোটো-ছোটো ইনিংস বেশ কার্যকরি প্রমাণিত হতে শুরু করে, তার পাশাপাশি বোলিংয়ে দু-একটি উইকেট নিয়ে ম্যাচে ভালোই অবদান রেখে নিয়মিত খেলে যাচ্ছিলেন জাতীয় দলের হয়ে।
জাতীয় দলের হয়ে সফর করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়েতে। এছাড়াও ২০০৯ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নিতে জাতীয় দলের হয়ে সফর করেছিলেন ইংল্যান্ড এবং ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নিতে পুনরায় উইন্ডিজের মাটিতে । দুই আসরেই হতাশাজনক পারফরম্যান্স করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ দলের মত নাঈমও ব্যর্থ হিয়েছিলেন নিজেকে মেলে ধরতে।
বাংলাদেশ দলের হয়ে ঘরের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপেও অংশ নেন নাঈম ইসলাম। ব্যাট হাতে খুব একটা সাফল্য না এলেও, সে বিশ্বকাপের তিন জয়ের মধ্যে দুই জয়ে বল হাতে অবদান ছিলো নাঈমের।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে শেষদিকে তার নেওয়া উইকেট এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যান্ড্রু স্ট্রস এবং ভয়ংকর হয়ে ওঠা ইয়ন মরগ্যানকে ফিরিয়ে বাংলাদেশ কে ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছিলেন নাঈম। ব্যাট হাতে পুরোপুরি ব্যর্থ বলা হলেও ভুল হবে, কেননা আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে তামিম ও ইমরুলের উড়ন্ত সূচনার পরেও ধসে পড়ে ব্যাটিং অর্ডার। ৮ নম্বরে নেমে নাঈমের ২৯ রানের লড়াকু ইনিংসে, ম্যাচে লড়াই করার পুঁজি পায় দল।
২০১১ বিশ্বকাপ পরবর্তী বছরের শেষদিকে উইন্ডিজের বিপক্ষে হোম সিরিজে সুযোগ পেয়ে প্রথম ম্যাচে ৫২ করেন। সিরিজের পরের ম্যাচ মুশফিকের ক্যারিয়ারের ১০০ তম ম্যাচ ছিলো। মুশফিকের সাথে নাঈম ছাড়া কেউই ব্যাট হাতে রান করতে পারেনি সেদিন। পরের বছর আবারও উইন্ডিজ সিরিজে খুলনায় প্রথম ম্যাচে অপরাজিত ৫০ করে মুশফিককে সহ জয় নিয়ে মাঠ ছাড়েন। পরের ম্যাচগুলোতে আর তেমন ব্যাট হাতে জ্বলে উঠতে পারেননি। তবে বল হাতে দু ম্যাচে দারুণ ইকোনমিকাল ছিলেন। পরের বছর রঙিন জার্সিতে ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করেন নাঈম।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১৩ হোম সিরিজে ৮৪ ও ৬৩ রানের দুটি ইনিংস তাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। সবাইকে ছাড়িয়ে সিরিজের সর্বোচ্চ রান (১৬৩) সংগ্রহকারী হয়েছিলেন নাঈম। ম্যান অব দ্য সিরিজের জন্য মুশফিক তাকে অগ্রীম অভিনন্দন জানালেও মুশফিক ক্যাপ্টেন্স নকের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য সিরিজ৷ মুশফিক নিজেই অবাক হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য সিরিজে নিজের নাম শুনে।
জাতীয় দলের সাথে ছয় বছরের যাত্রায় সেরা সিরিজ ছিলো নাঈমের এটি। কিন্তু এর পরবর্তী ২০১৪ এশিয়া কাপ ও শ্রীলঙ্কা সফরে সুযোগ অনুযায়ী তিন ম্যাচে ভালো খেলার পরেও দল থেকে বাদ পড়েন। টিম কম্বিনেশনের নামে নাঈমের এই আকষ্মিক বাদ পড়ায় অবাক হয়েছিলেন দেশের ক্রিকেট ভক্তরা। ২০১৪ সালে বাদ পড়ার পর আর ফেরত আসা সম্ভব হয়নি নাঈমের জাতীয় দলে। নাঈম নিজেও আক্ষেপ করেন ভালো পারফর্ম করেও জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ায়। নাঈমের কাছ থেকে জাতীয় দল তার সেরাটা আদায় করার সময়-ই তাকে দল থেকে বাদ পড়তে হয়েছে। নাঈমের জন্য যতোটা না হতাশাজনক, তারচেয়ে বেশী আক্ষেপ জাতীয় দলের নাঈমের অবদান মিস করায়।
৬ বছরের ক্যারিয়ারে ওয়ানডে খেলেছেন বেশি। ২০০৮ সালে অভিষেকের পর ৫৯ ওয়ানডেতে অংশ নিয়েছিলেন জাতীয় দলের জার্সিতে৷ অভিষেকের একবছর পর প্রথম অর্ধশতক করেন নাঈম চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ৯০ বলে ৭৩ রানের অপরাজিত সেই ইনিংস নাঈম কে তারকা খ্যাতি এনে দেয়। সিরিজ নির্ধারণী সে ম্যাচে ২২২ রানের টার্গেটে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ। রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে তামিম সাজঘরে ফিরে গেলেও, ফেরত আসেন শেষদিকে। কিন্তু রান আউট হয়ে আবার ফেরত যান। সেখান থেকেই অসাধারণ এক কীর্তি গড়ে দল কে এক উইকেটে জেতান নাঈম ইসলাম। চামু চিবাবাকে পর পর তিন বলে তিন ছয় হাঁকিয়ে ইতিহাস গড়েন নাঈম ইসলাম। নাঈমের কল্যানেই সিরিজে জয়লাভ করে বাংলাদেশ।
একই বছর ঘরোয়া লীগে মার্শাল আইয়ুব কে ছয় বলে ছয় ছক্কা হাঁকিয়ে রেকর্ড গড়েন প্রথম বাংলাদেশী ক্রিকেটার হিসেবে ছয় বলে ছয় ছক্কা হাঁকানোর। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস থেকে তাই কখনো চাইলেও মুছে দেওয়া যাবেনা নাঈমের এই ইনিংস। ইতিহাসের খাতায় আজীবন জ্বলজ্বল করবে নাঈমের নাম।
টেস্ট ক্রিকেটে দীর্ঘক্ষণ মাঠে থাকা জরুরী৷ সময় পার করে উইকেটে টিকে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নাঈম ইনিংস খুব বড় করতে না পারলেও দীর্ঘক্ষণ মাঠে টিকে থেকে সময় পার করতে পারতেন। মাঠে টিকে থেকে অন্য ব্যাটসম্যান কে সঙ্গ দিতে পারতেন। ক্যারিয়ার সেরা ১০৮ রান করেছিলেন মিরপুরে উইন্ডিজদের বিপক্ষে।
২৫৫ বলে ১০৮ রানের ইনিংসে নাঈম প্রমাণ করেছিলেন ব্যাটিংয়ে টেস্টের সঠিক মেজাজ বিদ্যামান তার মাঝে। যদিও এখন পর্যন্ত মাত্র ৮ টেস্ট খেলার সুযোগ হয়েছে তার। যদিও ৮ ম্যাচের ক্যারিয়ারে তার গড় ছিলো ৩২। দুই ফরম্যাটেই সামর্থের জানান দিয়েছিলেন টি-টুয়েন্টি ছাড়া। তখন খুব একটা টি-টোয়েন্টি খেলার সুযোগও পেতো না বাংলাদেশ তাই নাঈমেরও সুযোগ হয়নি জাতীয় দলের জার্সি গায়ে বেশি টি-টোয়েন্টি খেলার।
ঘরোয়া লিগে নাঈম একজন নিয়মিত পারফর্মার। যেকোনো ফরম্যাটেই রান করে যান নিয়মিত। শেষ কয়েকবছর ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে পারফর্ম করেছেন নজরকাড়া। যেই নজর শুধু দর্শক আর সাংবাদিকদের কাড়লেও, ব্যর্থ হয় নির্বাচকদের নজর কাড়তে। নিয়মিত পারফর্ম করেও জাতীয় দলে সুযোগ না পেয়ে হতাশ হলেও, নাঈম তার কাজ করে যাচ্ছেন নিয়মিত হতাশাকে আড়ালে রেখে। নাঈম নিয়মিত খেলতে ভালোবাসেন তাই এখনও খেলে যান বয়স ৩৩ পেরোনোর পরেও।
প্রথম দুই বছর বিপিএলে খেলেছেন চিটাগাং কিংসের হয়ে, পরেরবার খেলেছেন চিটাগাং ভাইকিংসের হয়ে। ২০১৬ বিপিএলে অধিনায়কত্ব করেছেন রংপুর রাইডার্সের। সেই আসরেই মাঠে তাকে অধিনায়কত্ব করতে ব্যাঘাত ঘটান শহীদ আফ্রিদি৷ হয়তোবা দল থেকেই আফ্রিদি কে মাঠে অধিনায়কত্ব করতে বলা হয়েছিলো৷ যদিও এই নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি এখনও। পরের তিনবছর কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি তাকে দলে ভিঁড়ানোর আগ্রহ দেখায়নি।
বর্তমান দ্রুত গতির ক্রিকেটের সাথে নাঈমের ২০০৮-১৪ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার বেমানান মনে হলেও, নাঈম যখন জাতীয় দলে ছিলো তখন নিয়মিত জয় পাওয়া ছিলো দূরূহ ব্যাপার বাংলাদেশের জন্য। তারপরও নাঈম তার পছন্দের পজিশনের বাইরে গিয়ে ৮ নম্বরে ব্যাটিং করে ছোটো কিছু ক্যামিও ইনিংস উপহার দিয়ে দলের সংগ্রহ বাড়িয়েছিলেন, অথচ নিজের পছন্দের পজিশন ছিলো ৪/৫।
তারপরেও তিনি ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় দলের প্রয়োজনে ৮ নম্বরে ব্যাটিং করেছিলেন। তাছাড়া ২০০৮-২০১৩ সময়টা ৩০ রান করাটাই অনেক ছিলো জাতীয় দলের ব্যাটসম্যানদের জন্য। নাঈম সেই অনুযায়ীই খেলেছিলেন রঙিন পোশাকে, ৫৯ ম্যাচে ২৭ গড়ে ৯৭৫ রান আর বল হাতে পার্ট-টাইম অফ স্পিনে শিকার করেছিলেন ৩৫ উইকেট। ব্যাটে-বলে সমান তালে পারফর্ম করা যাকে বলে।
তাতে কি, তাঁর ক্যারিয়ারের কফিনে তো এখন শেষ পেড়েক ঠুকে গেছে বলা যায়!