একটি ক্ষণস্থায়ী ঘূর্ণিঝড়

আশির দশক। ইন্দোরে ট্রায়াল চলছে। ১৪ বছরের এক ছেলে এক হাজার কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন নির্বাচকদের সামনে। ‘আমি ভারতের হয়ে খেলব’ – শুনে নির্বাচকরা হেসেই উড়িয়ে দিলেন। শৈশবের সেই তাচ্ছিল্যে ভেঙে পড়লেন না নরেন্দ্র হিরওয়ানি।

আশির দশক। ইন্দোরে ট্রায়াল চলছে। ১৪ বছরের এক ছেলে এক হাজার কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন নির্বাচকদের সামনে। ‘আমি ভারতের হয়ে খেলব’ – শুনে নির্বাচকরা হেসেই উড়িয়ে দিলেন। শৈশবের সেই তাচ্ছিল্যে ভেঙে পড়লেন না নরেন্দ্র হিরওয়ানি।

এরপর চললো পাঁচ বছরের অপেক্ষা। তিনি আসলেন চোখে চশমা, মাথায় হেড ব্যান্ড হাতে রিস্ট ব্যান্ড লাগিয়ে, গোঁফের ফাঁকে হাসি নিয়ে। অভিষেকেই ড্রেসিংরুমে ঘোষণা দিয়ে দিলেন, ‘ভিভ রিচার্ডসের উইকেটটা আমিই পাব।’

সত্যি হল সেই ঘোষণা, ফ্লিপারে উপড়ে গেল হতবিহ্বল ভিভের স্ট্যাম্প। এমন লজ্জা তাঁকে ক’জনই বা দিতে পেরেছেন। মাদ্রাজের সেই টেস্ট জুড়েই চললো গুগলি, ফ্লিপার, লেগব্রেক-সহ সকল রকম লেগ স্পিন অস্ট্রের প্রদর্শনী। পাঁচ বছর আগে যে কিশোরকে বাতিল করে দিয়েছিলেন নির্বাচকরা সেদিন তিনিই জ্বালিয়ে ছাড়খাড় করে দিলেন রেকর্ড বই!

নরেন্দ্রনাথ হিরওয়ানি – চট করে হয়তো একালের ক্রিকেট দর্শকরা এই ভদ্রলোককে চিনতে পারবেন না। নব্বই দশকে যারা ক্রিকেট দেখেছেন, তাঁদের মনে হয়তো আবছা একটা অবয়ব তৈরি হবে। তিনি আক্ষরিক অর্থেই ক্রিকেটের বিস্মৃত এক চরিত্র। ভারতের ক্রিকেট তাঁকে ভুলে গেলেও ইতিহাসের পাতা থেকে এখনও তাঁর নাম মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি।

অবশ্য হিরওয়ানি ভুলে যাওয়ার পেছনে গড়পরতা একজন দর্শকের কোনো দায়ও নেই। দায় বেশি তাঁর নিজেরই। ভারতীয় দলের জন্য দারুণ এক সম্পদ হওয়ার সুযোগ থাকার পরও তিনি সেটা হতে পারেনি। সেই পাওয়া-না পাওয়ার গল্পটাই আজ বলতে চলেছি।

যে কোনো দিন, যে কোনো কন্ডিশনে, যে কোনো দলের বিপক্ষে, যে কোনো প্রেক্ষাপটেই এক টেস্টে ১৬ উইকেট নেওয়া বিরাট ব্যাপার। আর সেটা যদি সেই ১৯৮৮ সালের প্রতাপশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নেওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই।

হ্যাঁ, এই কাণ্ডটিই ঘটিয়েছিলেন নরেন্দ্র হিরওয়ানি। গল্পতে টুইস্ট আছে আরও, সেটা ছিল এই লেগ স্পিনারের অভিষেক টেস্ট। ১৩৬ রান দিয়ে তিনি ১৬ উইকেট নেন। প্রতি ইনিংসে নিয়েছিলেন আটটি করে উইকেট।

ভারত ম্যাচটিতে ২৫৫ রানের বিরাট ব্যবধানে জেতে। জয়টা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ভারতের জন্য। কারণ, এর আগে টানা নয় বছর ক্যারিবিয়ানরা অপরাজিত ছিল ভারতের বিপক্ষে।

আজও অভিষেকে যে কোনো বোলারের সেরা বোলিং ফিগার এটাই। হিরওয়ানির বয়স তখন মাত্র ১৯। ক্যারিয়ারের প্রথম চার টেস্টেই নেন ৩৬ ‍উইকেট। সেখান থেকে তাঁর ক্যারিয়ারের গ্রাফ যেমন হওয়া উচিৎ ছিল, তেমন হয়নি।

পরের নয়টি টেস্টই খেলেন দেশের বাইরে। তাতে ৫৯ গড়ে পান ২১ ‍উইকেট। তখন থেকেই তিনি দলে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাননি। সর্বশেষ জাতীয় দলে খেলেন ১৯৯৬ সালে। ১৭ টেস্টে ৬৬ উইকেট আর ১৮ ওয়ানডেতে ২৩ উইকেটেই ইতি ঘটে তাঁর ক্যারিয়ারের। বিশেষ করে, অনিল কুম্বলের মত স্পিন দানবের আবির্ভাব হিরওয়ানির বিদায় আরও ঘনিয়ে আনে।

২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে স্কোয়াডে ডাক পেলেও একাদশে জায়গা হয়নি। ঘরোয়া ক্রিকেট অবশ্য খেলেছেন ২০০৫-০৬ মৌসুম অবধি। আর সেখানে তিনি কিংবদন্তি ছিলেন। ১৬৭ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ৭৩২ টি উইকেট। এর মধ্যে মধ্য প্রদেশের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে পেয়েছেন ৪০০’র বেশি উইকেট।

২৩ বছরের লম্বা খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে ক্রিকেটের সাথেই ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) জাতীয় নির্বাচক হিসেবে নিয়োগ পান। মধ্যপ্রদেশের রঞ্জি ট্রফির টুর্নামেন্ট সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন ২০১৪ সালে। ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমির স্পিন কোচ ছিলেন। ভারতের মেয়েদের দলের সাথে কাজ করেছেন। তবে, এত কিছুও তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের আক্ষেপকে মুছে ফেলতে পারেনি!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link