সকল নিন্দার জবাব উড়ন্ত চুমুতে

একটা আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভাকেও শীতল করা যায়। একটা উন্মাদের দলকে বিমোহিত করা যায়। সমুদ্রের নোনা জলও নদীর মিঠা পানি হয়। এসব কিছুই যেন করে দেখালেন নাজমুল হোসেন শান্ত। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কাণ্ডারি তিনি। শান্তই এখন আস্থার সুবিশাল এক স্তম্ভ।

গোটা একটা জাতি দিনের পর দিন ট্রল করে গেছে। সমালোচনার চাইতে হয়েছে নিন্দা। কতশত কটু কথা! দিন বদলে যেতে সময় নেয় না। শান্তরা দিন বদলে দিতে জানেন। এই যে যেমনটা শান্ত করে দেখাচ্ছেন ঘরে-বাইরে সবখানে।

নাজমুল শান্তর একটা বিষয় বেশ প্রশংসনীয় তিনি রাজ্যের সব ট্রল আর নিন্দার জবাবটা কখনো মুখে দেননি। তিনি বরং অপেক্ষা করেছেন নিজের সময়ের। তিনি অপেক্ষা করেছেন চেমসফোর্ডের কোন এক স্বর্ণালী সন্ধ্যার। আর তাতেই তিনি যেন সকল গ্লানি থেমস নদীতে বিসর্জন দিলেন। এরপর উড়ন্ত চুমু যেন ছুঁড়ে দিলেন নিন্দুকদের দিকে।

শান্তর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। বিশেষ কিছু তো বটেই। প্রতিটা ব্যাটারের কাছে সেঞ্চুরির মাহাত্ম্য অনেক। তিনি হয়ত কখনোই শ’খানেক শব্দের বেড়াজালে সেই অনুভূতি আটকে ফেলতে পারবেন না। তবে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে চেমসফোর্ডের ওই শীতল আবহাওয়া উপেক্ষা করে শান্ত রীতিমত চিন্তারাজ্যে জোরে-সোরে আঘাত করলেন।

পরিস্থিতি বিবেচনায় শান্তর এই ইনিংসটি স্মৃতির দৃশ্যপটে বিশাল জায়গা দখল করবার কথা। প্রথমত কনকনে ঠান্ডা।ডাগ আউটে থাকা প্রতিটা খেলোয়াড়ের কাঁচুমাচু দিয়ে বসে থাকাই সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। সেই সাথে খনে খনে হাড়হীম করা ঠান্ডা বাতাস। যাতে বলের দিকও হচ্ছিল প্রভাবিত।

একে তো বৈরি কন্ডিশন। অন্যদিকে, পাহাড়সম রান তাড়া করার একটা মানসিক চাপ। তার উপর টপ অর্ডারের সবাই তখন প্যাভিলিয়নে। তেমন একটা পরিস্থিতি থেকে শান্ত নিজেকে শান্ত রাখলেন। তিনি হিসেব করে খেলতে লাগলেন। তাওহীদ হৃদয়ের সাথে করা জুটিটায় দু’জন প্রতিটা বল শেষে কথা বলেছেন।

শান্তর কাছে হৃদয় বহুবার বলের মেরিট বোঝার জন্য প্রশ্ন করেছেন। শান্ত ভরসা জুগিয়েছেন হৃদয়কে। তিনি নিজেও ভরসা দিয়েছেন প্যাভিলিয়নে থাকা গোটা দলকে। শেষ অবধি ৮৩ বলে শতকের দেখা পেয়ে জান শান্ত। বিদেশের মাটিতে এটাই বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় দ্রুত গতির শতক। প্রথম আর তৃতীয় অবস্থানটা একাই দখলে রেখেছেন সাকিব আল হাসান।

কন্ডিশন, দলের পরিস্থিতি বিবেচনায় শান্তর খেলা ১১৭ রানের এই ইনিংসটি তার সামর্থ্যের প্রমাণ রাখে। এটাই বুঝিয়ে দেয় যে, ঠিক কি কারণে দিনের পর দিন তার পিছনে সময় ব্যয় করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে শুরু করে টিম ম্যানেজমেন্ট। এমন সব দিনের জন্যেই তো শান্তদের গড়ে তুলতে সময় প্রয়োজন।

তবে হুট করেই শান্ত দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে ফেললেন, বিষয়টি তো তেমনও নয়। তিনি তো একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যাচ্ছেন। তিনি তো তিলে তিলে নিজেকে গড়েছেন। এই তো শেষ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেও হয়েছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।

শেষ দশ ওয়ানডে ইনিংসে তিনি তিনটি অর্ধ-শতকের দেখা পেয়েছেন। প্রায় প্রতিটা ম্যাচে রান এসেছে তার ব্যাট থেকে। তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন নিজের সক্ষমতা। ঠিক এই কারণেই হয়ত দেশী-বিদেশী প্রতিটা কোচের চোখে শান্ত ছিলেন স্পেশাল কিছু। তবে নিজের সক্ষমতা হয়ত এতদিন শান্তর নিজেরই ছিল অজানা।

এখন তিনি জানতে শুরু করেছেন। তিনি জানেন, তিনি চাইলেন এমন সব চোখ ধাঁধানো ইনিংস খেলতে পারেন। তিনি জানেন চাইলেই ব্যাটের সাথে বলের শ্রুতিমধুর ধ্বনি ছড়িয়ে বলকে মাঠ ছাড়া করতে পারেন। এখন তবে শান্তর প্রশংসা করা উচিত।

শান্তর এই ফুলে-ফেঁপে ওঠা আত্মবিশ্বাসে আরও একটু ভাললাগা ছড়িয়ে দেওয়া উচিত সকলের। বিশেষ করে রাতদিন ট্রলে মেতে থাকা উন্মাদদের। শান্ত নিশ্চয়ই এবার ক্ষমা প্রার্থণার আশা করতেই পারেন। ঠিক যতটা নিন্দা হয়েছে তার সমপরিমাণ প্রশংসা না হোক ইতিবাচক সমালোচনা এখন তার প্রাপ্য।

এই পুরো বাংলা যতটা উন্মত্ত হয়েছিল তার বাজে সময়ে, এখন নিশ্চয়ই ততটাই উন্মাদনা ছড়িয়ে দিচ্ছেন শান্ত। এমন সব ম্যাচজয়ী ইনিংস দিয়ে তিনি আনন্দে ভাসাচ্ছেন পাগলাটে এক ক্রিকেট গোষ্ঠীকে। এই ধারা অব্যাহত থাকুক। শান্ত ছুটতে থাকুক নিজের আপন গতিতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link