টোয়েন্টি ইয়ার্স চ্যালেঞ্জ ও একটি রূপকথা

সাল ১৯৯৮।

ফ্রান্সের সেন্ট ডেনিস স্টেডিয়ামে চলছে ৯৮’-এর বিশ্বকাপ। ফরাসিদের ফুটবল জাদুতে মজে আছে প্যারিস শহর। স্টেডিয়ামের বাইরে তখন সমর্থকদের ভিড়, প্লাস্টিকের বোতল, বিয়ার ক্যান ছড়িয়ে রয়েছে যত্রতত্র। ছেলেটা প্রাণপণে কুড়িয়ে নিয়ে ভরে চলেছে নিজের থলেতে। বিশ্বকাপের মৌসুমে এদের লাভ দ্বিগুণ, মালিকের কাছে দিনশেষে জমা করে হাতে কিছু টাকা আসছে; বিধবা মায়ের হাতে রাতে সেই টাকা তুলে দিচ্ছে ফ্রান্সের রিফিউজি, বয়স তখন মাত্র ৮ বছর।

সাল ১৯৯৯।

প্যারিসের রাস্তায় আঁখের রস বিক্রি করতে করতে চোখ যাচ্ছে বিশাল ব্যানার আর হোর্ডিংগুলোর দিকে; ফরাসি ফুটবলে তখন নবজাগরণের সময়, ফুটবল একাডেমি কয়েকগুন বেড়ে গেছে বিশ্বকাপ জয়ের পর, জিদানের ছবি দেখে ইচ্ছে করছে একটাবার যদি ওই সাদা ফুটবলটা পায়ে নিতে পারত – পরক্ষণেই মনে হচ্ছে আঁখের বিক্রি কমে গেলে অচল হয়ে যাবে মায়ের চিকিৎসা!

২০০২ সাল।

একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই ফেলল ছেলেটা। ‘জে এস সুরেস্নেন’ অ্যাকাডেমিতে একটা হলুদ ঢোলা জার্সি গায়ে দিয়ে চলে গেল সে, বয়সে তিন বছরের বড় ছেলেদের সাথে প্র‍্যাকটিস ম্যাচে নজর কাড়ল কোচের, ব্যাস, সকালে আঁখের রস বিক্রি আর সন্ধ্যায় প্লাস্টিক কুড়োনো, দুই পেশার মাঝে দুপুরে চলতে লাগল ফুটবল- এক উন্মত্ত নেশা।

২০০৪ সাল।

কোচ ভক্তিয়ানা খেয়াল করলেন ছেলেটাকে, তেমন ড্রিবলিং নেই,তেমন স্কিল নেই কিন্তু কোচের প্রতিটা কথা যেন একলব্যের মতো মেনে চলছে ও,ওর অস্ত্র মাটি ঘেঁসে কড়া ট্যাকল আর অবিশ্বাস্য দম, একদিন মজা করে কোচ বললেন- ” কান্তে, তুমি বাঁ পা, ডান পা আর হেড মিলিয়ে মোট ১৫০০ বার বল জাগলিং করে দেখাতে পারবে?

প্র‍্যাকটিস শেষের অনেকক্ষণ পর যখন ভক্তিয়ানা নেট হাতে নিয়ে ঘরে ফিরছেন তিনি খেয়াল করলেন সন্ধ্যে নেমে গেলেও মাঠের এক কোণায় একা বল জাগলিং করে যাচ্ছে কান্তে!

২০১৮ সাল।

বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে শ্যাম্পেন স্নানে মেতেছে গ্রিজম্যান, এমবাপ্পে, জিরুদ-সহ গোটা ফ্রান্স টিম। অনেকটা দূরে একা দাঁড়িয়ে আছে ভিয়েরা, ম্যাকালেলের উত্তরসূরি এনগোলো কান্তে। অলিভার জিরু এগিয়ে এসে হাত ধরে ডায়াসে তুললেন কুঁকড়ে থাকা ছেলেটাকে। বিশ্বজয়ের পরেও যেন ম্লান একটা হাসি, সকলে মিলে হাতে সোনার কাপটা তুলে দিল- ‘ইটস ইওর কাপ কান্তে, টেক ইট…’, একবার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল যেন!

এমবাপ্পে-গ্রিজম্যান-উমতিতি-ভারানে নিয়ে কথা হয়েছে প্রচুর, ফ্রান্সের বিশ্বজয়ের দিনেও যেন নিজের কাজটুকু করে সমস্ত লাইমলাইট থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে মানুষটা। চেলসির নীল জার্সি হোক কিংবা ফ্রান্সের পতাকা- এনগোলো কান্তে মাঠে নামলে নিংড়ে দেন সবটুকু।

সুপার কাপ ফাইনালে নিজের চোট নিয়ে ১২০ মিনিট মাঠে লড়ে গেলেন সেদিনের ছোট্ট উদবাস্তু ছেলেটা যার শৈশবের পাথুরে জমি তিনি নিজের চেষ্টায় বদলে দিয়েছেন সবুজের গালিচায়। আধুনিক ফুটবলের রূপকথার গল্প লেখা হলে তাঁর বন্দিত নায়কের নাম হবে এনগোলো কান্তে।

২০২১ সাল।

এবারের গল্পটা করো অজানা নয়। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ যে চেলসি জিতে গেলে তাতে থমাস টুখেলের দলের মধ্যমাঠ আবর্তিত হয়েছে এই এনগোলো কান্তেকে ঘিরে। নব রূপকথার নায়কও কান্তেই। সেমিফাইনালের ম্যাচ সেরা, ফাইনালেও তাই – তাই টপ ফেবারিট পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটির কপালের লিখন খণ্ডানো গেল না। ইউরোপা তিনি এই চেলসির হয়ে আগেই জিতেছেন, এবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ – ইউরোপের চূড়ান্ত শ্রেষ্ঠত্ব।

শত যন্ত্রণাও যার মুখ থেকে হাসিটুকু কেড়ে নিতে পারে নি কেউ। গোল্ডেন বল, গোল্ডেন বুট, ব্যালন ডি অরের পৃথিবীতে এমন এক উদবাস্তু অসহায় ছেলের একটা ‘টোয়েন্টি ইয়ার্স চ্যালেঞ্জ’ এর রূপকথা আর দেখাতে পারবেন? কেউ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link