বিশ্বকাপ ফুটবল দিয়ে জার্মান ফুটবলারদের উত্থানের গল্প নতুন কিছু নয়। সারা বছর অখ্যাত ট্যাগ জুড়ে থাকা খেলোয়াড়ও বিশ্বকাপে এসে হয়ে যান তুরুপের তাস। ২০০৬ বিশ্বকাপে এমন একটি গল্প লিখেছিল লুকাস পোডলস্কি। সে বারের সেরা তরুণ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
এর পরের বিশ্বকাপেও সেই ধারা অব্যাহত রাখেন আরেক জার্মান। ২০১০ সালে সেবারের বিশ্বকাপে সেরা তরুণ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন থমাস মুলার। আর এই মুলার, এবারের বিশ্বকাপে একমাত্র ফুটবলার যার বিশ্বকাপে ১০ টি গোল রয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বকাপ আসলেই যেন এক ধরনের পুনর্জাগরণে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে জার্মানি দলটা।
তবে, এখন পর্যন্ত এবারের জার্মানির পারফরম্যান্সে সেই ব্যাপারটা দেখা গিয়েছে একটু কমই। প্রথমত জাপানের কাছে হেরে শুরু। এরপর স্পেনের বিপক্ষে ড্র। পরবর্তী রাউন্ডে উঠতে তাই শেষ ম্যাচটা জেতাই লাগবে তাদের। তবে, এত আশা নিরাশার দোলাচলের মাঝে একটু খানি আলোর ঝলকানি দেখিয়েছেন নিক্লাস ফুলক্রুগ। স্পেন ম্যাচের আগে মাত্র দুই ম্যাচের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ছিল ফুলক্রুগের। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে বদলি নেমে গোল করেছিলেন তিনি। প্রায় হেরে যাওয়া একটি ম্যাচে ত্রাতা হয়ে হাজির হয়েছিলেন ২৯ বছর বয়সী এ ফরোয়ার্ড।
কারণ তাঁর গোলেই স্পেনের বিপক্ষে হার এড়াতে পেরেছিল জার্মানি। ফুলক্রুগের ঐ গোলটি না হলে জার্মানির বিশ্বকাপ স্বপ্ন এতক্ষণে মাঝ সমুদ্রেই চলে যেত। আর এই ফিকে যাওয়া স্বপ্ন পুনরুদ্ধারের জন্য ফুলক্রুগও চলে এসেছেন আলোচনায়। অখ্যাত ফুটবলার থেকে হঠাৎই হয়ে উঠেছেন টক অব দ্য টপিক।
ফুলক্রুগ মূলত খেলেন বুন্দেসলিগাতে। তবে তেমন কোনো বড় ক্লাবের জার্সি গায়ে চাপানোর সুযোগ হয়নি তাঁর। খেলেন ভেরদার ব্রেমেনের হয়ে। তবে ব্রেমেন তো আর প্রথম স্তরের কোনো ক্লাব নয়। গত বছরেই দ্বিতীয় স্তর থেকে প্রথম স্তরে যাওয়ার লড়াই করছিল এই ক্লাবটি। আর এমন সময়ে বেশ হতাশায় মুষড়ে পড়েন ফুলক্রুগও। এমনকি ফুটবলটা ছেড়ে দেওয়ার কথাও একবার ভেবেছিলেন তিনি।
কারণ, এক যুগের ক্যারিয়ারে খেলেছেন বেশ কয়েকটি ক্লাবে। কিন্তু কোনোটিতেই তেমন থিতু হতে পারেননি। ব্রেমেনের পর ন্যুরেমবার্গে খেলেছিলেন কিছুদিন। এরপরে খেলেছেন হ্যানোভারে। কিন্তু কোনোটিই তো আর প্রথম সারির ক্লাব নয়। এভাবে বয়সও ২৮ গড়িয়ে গেলে আর বড় কোনো ক্লাবে খেলার সুযোগ পাননি ফুলক্রুগ। তাই আবার ফিরে এসেছিলেন সেই ব্রেমেনেই।
তবে দারুণ কিছু করে দেখানোর তাড়না ফুলক্রুগের মধ্যে সব সময়ই ছিল। সেই তাড়নায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন গত মৌসুমে। বুন্দেসলিগার দ্বিতীয় স্তরের লিগে ২০২১-২২ মৌসুমে করে বসেন ১৯ গোল। আর এতেই দ্বিতীয় স্তর পেরিয়ে সরাসরি বুন্দেস লিগায় চলে আসে ব্রেমেন। এর পরেই হ্যান্সি ফ্লিকের নজরে চলে আসেন ফুলক্রুগ। যদিও বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাবেন কিনা তা নিয়েও ছিল ঘোর অনিশ্চয়তা। তবে টিমো ওয়ের্নারের চোটের কারণে সেই অনিশ্চয়তাও কেটে যায়। বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পান ফুলক্রুগ।
আর এর পরের দৃশ্যপট তো জানাই। বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচেই নামলেন বদলি হিসেবে। তবে স্পেনের বিপক্ষে বদলি নেমে করে বসেন দুর্দান্ত এক গোল। বিশ্বকাপে জার্মানির ম্রিয়মাণ পথযাত্রায় একটু আলো ফুটে উঠেছিল ঐ একটি গোলেই।
আর এ ম্যাচের পরেই ফুলক্রুগের প্রশংসার পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে জার্মানরা। জার্মান কিংবদন্তি ফুটবলার তো বলেই দিয়েছেন, পরের ম্যাচের শুরু থেকেই ফুলক্রুগকে খেলানো উচিত। আবার জার্মানির আরেক ফুটবলার টনি ক্রুজ বলেছেন, ‘আমাদের দলে সব কিছুই ঠিক ছিল। কিন্তু মিরোস্লাভ ক্লোসা, মারিও গোমেজের মত গোলস্কোরারের অনুপস্থিতি বেশ কিছু বছর ধরে মেটানো যায়নি। ফুলক্রুগের মধ্যে আমি সেই সম্ভাবনাটা দেখতে পাচ্ছি। ও দারুণ একজন স্ট্রাইকার।’
ফুলক্রুগকে নিয়ে কথা বলেছেন তাঁর আগের ক্লাব হ্যানোভারের ক্লাব ডিরেক্টরও। তিনি বলেন, ‘আমার দেখা অন্যতম সেরা নাম্বার নাইন ফুলক্রুগ। ওর সবচেয়ে ভাল গুণ হল, ও খুব আত্মবিশ্বাসী। তবে তাঁর দুর্ভাগ্য হল, ইনজুরি। এই ইনজুরির কারণেই সে খুব বড় পর্যায়ে যেতে পারেনি। কারণ এমন একটি মৌসুমও নেই যে, ও ইনজুরিতে পড়েনি। তবে যখনই খেলতে নামে তখনই ও খুব প্যাশন নিয়ে খেলতে নামে। আর ফুলক্রুগের স্কোরিং এক্যুরেসিও দারুণ।’
ফুলক্রুগের বাবা, দাদা- দুজনই পেশাদার ফুটবল খেলেছেন। মূলত তাদের হাত ধরেই ফুলক্রুগেরও ফুটবলে আসা। জার্মানির বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন বেশ ক’বার। কিন্তু সেই পথ গড়িয়ে কখনোই তেমন শিখরে যেতে পারেননি তিনি। অবশেষে সেই দ্বার কিছুটা উন্মোচিত হচ্ছে। অখ্যাত থেকে উঠে এলেন একদম দৃশ্যপটে। এখন শুধু প্রয়োজন এগিয়ে চলার প্রত্যয়। সেই প্রত্যয়কে সঙ্গী করে ফুলক্রুগ যতটা এগোবে, জার্মান মেশিনও ঠিক ততটাই সচল থাকবে।
বিশ্বকাপ ফুটবলের মাহাত্ম্য তো এখানেই। উত্থান পতনের দৃশ্যায়নে হাসি কান্না জুড়ে বহমান স্রোতধারার মত চলতে থাকে দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। ফুলক্রুগের এ উত্থান আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, আর ভাবায়, এভাবেও তো ফিরে আসা যায়।