প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলতে নেমেই পাকিস্তানকে হারিয়ে ইতিহাস রচনা করেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। ১৯৯৯ সালের ৩১ মে পুরুষ দল এই পাকিস্তানকে হারিয়ে প্রথম জয় পেয়েছিল আর এবার নারীরাও করলো ইতিহাস। সেই দলটিকে এক সুতোয় গেঁথেছেন নিগার সুলতানা জ্যোতি। তিনি এখন যেন বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই জ্যোতি।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ইতিহাস করা ম্যাচে ব্যাট হাতে ৪৬ রানের দারুণ আর কার্যকরী ইনিংস খেলেছেন। যদিও হাত ছোয়া দুরত্বে থাকা ওয়েষ্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচটা জেতা হয়নি বাংলাদেশের। ক্যারিবীয়দের মাত্র ১৪০ রানে অলআউট করেও হারতে হয়েছে ৪ রানে। নাহিদা আক্তারের সমান ২৫ রানও এসেছে তার ব্যাট থেকে। কিন্তু খুব কাছে গিয়ে জয় না পাওয়ায় গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গেছে। এই ম্যাচটা জিততে পারলে কিছুটা হলেও আশা জিইয়ে থাকত লাল সবুজ পতাকাধারীদের। তবুও প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলতে নেমে ভাল খেলছে নারী ক্রিকেট দল।
বাছাইপর্বের বৈতরণী পেরিয়ে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলছে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দল। এই দলটির অধিনায়কত্ব করছেন নিগার সুলতানা জ্যোতি। শেরপুর থেকে উঠে আসা এই ক্রিকেটার এখন সারাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন নিউজিল্যান্ডে। বাংলাদেশের জ্যোতি হয়ে ভবিষ্যতে দেশের ক্রিকেটে অবদান রাখতে চান তিনি। জিম্বাবুয়েতে বাছাইপর্ব খেলার পর নিউজিল্যান্ডে মূল আসরে খেলছে লাল সবুজ প্রতিনিধিরা। পুরো দলটাকে দারুণভাবে নেতৃত্ব দিয়ে বাছাইপর্বে সাফল্য পেয়েছেন অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি। জন্মভিটাকে ছাড়িয়ে কিভাবে তিনি গোটা দেশের ‘জ্যোতি’ হয়ে উঠলেন, সেটা জানার কৌতুহলী মানুষের সংখ্যা এখন অনেক। নিজেকে সেই ছোটবেলা থেকেই অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা করে রেখেছিলেন।
জন্মভুমি শেরপুরের প্রবেশদ্বার কানাশাখেলা মোড়ে যে তার কত ভোর সকাল হয়েছে তার কোন সঠিক হিসাব নেই। নিজের ফিটনেস ঠিক রাখতে এই রাস্তায় নিয়মিত অনুশীলন করতেন জ্যোতি। সূর্যোদয়ের আগেই বেরিয়ে পড়তেন বাড়ি থেকে। ট্র্যাকস্যূট পড়া একটি মেয়েকে এভাবে দৌড়াতে দেখে টিপ্পনি কাটা মানুষের সংখ্যাও কম ছিলনা। তবে তাতে থোরাই কেয়ার।
জ্যোতি যে তৈরি হয়েছেন দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে, সে কারণে এসকল সমস্যাকে গায়ে মাখতেন না।
তাকে অভিশাপ দেওয়া মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম ছিলনা। তবে সেই পরিচিত মোড়েই ২০১৮ সালের ১৩ জুন বিরোচিতভাবে বরণ করে নেওয়া হয় তাকে। চারবছরের কিছুটা কম সময় আগে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপ ক্রিকেটে শিরোপা জেতার পর জাতীয় বীর হিসেবে দেশে ফিরেছিলেন। কাকতালীয়ভাবে ভারতের বিপক্ষে জেতা ফাইনালে সর্বোচ্চ স্কোরও করেছিলেন এই জ্যোতি।
চ্যাম্পিয়ন ট্যাগ গায়ে লাগিয়ে নিজ এলাকায় ফেরার পর শতাধিক মোটর সাইকেল সমেত ব্যান্ডপার্টির সাথে ’অভিশাপ’ দেওয়া সেই মানুষগুলো ছিলেন। জ্যোতি তাতে অসন্তুষ্ট ছিলেন না, বরং বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি কয়েকবছর আগে যা করেছেন তাতে এলাকার মানুষজনের সুনামই বয়ে এনেছে।
জ্যোতির শুরুর সময়ের কথা বলতে গিয়ে তার বাবা সিরাজুল হক বলেন, ‘জ্যোতির মা আর ভাই বেশি আগ্রহী ছিল তাকে ক্রিকেটার বানাতে। শুরুতে অনেক বাধা বিপত্তি পার হতে হয়েছে। মেয়েদের খেলা বন্ধ করতে স্টেডিয়ামের গেট আটকে দিলে মেয়েকে নিয়ে প্রাচীর টপকে মাঠে খেলতে হয়েছে। এছাড়া আমাদের বাড়ি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের ঝিনাইগাতিতে গিয়ে অনুশীলন করতে হয়েছে।’
জ্যোতির ভাই এসএম সালাহউদ্দিন সম্রাট ক্রিকেট খেলতেন শেরপুরে। ভাইকে দেখেই ক্রিকেটে আসা পরিবারের সবচেয়ে ছোট মেয়েটি বেশি জালিয়েছে তাকেই। একটা সময় শাইকা ক্লাবে ছেলেদের সঙ্গে খেলার জেদ করলে ভাই’ই সর্তীর্থদের বুঝিতে তাকে উইকেরক্ষক বানিয়ে দেন। অনেক কটু কথার শোনার পর পারফরম্যান্স দিয়ে একটা সময় সবকিছু চাপা দেন জ্যোতি। পরিবারের সবার ছোট হওয়ায় নানান বায়না থাকতই তার। বোনের সেসব ইচ্ছা পূরণে হাজারো সমস্যা পায়ে মাড়িয়ে দিয়েছেন নিজের সর্বোচ্চটা।
সালাউদ্দিন সম্রাট সেসব দিনের কথা মনে করেন আর ভাললাগায় ভেসে যান, ’ক্রিকেটের প্রতি জ্যোতির আগ্রহ দেখে আমিই তাকে খেলার সব ধরনের ব্যবস্থা করে দিই। নারী ক্রিকেটারদের মধ্যে সালমা খাতুনের ছবিটা তাকে বেশি করে দেখাতাম। দেখেন কি আশ্চর্যের বিষয়, সেই সালমাই এখন বিশ্বকাপ খেলছে জ্যোতির নেতৃত্বে। সবভাই-বোন মিলে ক্রিকেট খেলতাম। সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, সবার ছোট জ্যোতি এখন জাতীয় দলের অধিনায়ক।’
ক্রিকেটের বাইরে জ্যোতির জীবনটাও কম রোমাঞ্চকর নয়। স্থানীয় নবারুন স্কুলে ভালো ছাত্রী হিসেবে সবার কাছে পরিতি ছিল। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার পাশাপাশি গানের গলাও ছিল দারুণ। পারিবারিকভাবে শৃঙ্খল ভাঙ্গা গল্পটা তাদের অনেক পুরনো। জ্যোতির দাদা সাইযউদ্দিন পা দিয়ে হারমোনিয়াম বাজাতেন! ফুটবলে খ্যাপ খেলতেন আর গান করতেন। পরিবারের লোকজন বলাবলি করে, দাদা খেলা আর গান দুটোই পেয়েছেন জ্যোতি। দাদার মতো ফুটবল খেলেছেন শেরপুর গার্লস স্কুলের হয়ে। এর বাদেও. শেরপুর জেলা দলের হয়ে ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। খেলেছেন হ্যান্ডবলের মতো খেলাও। সে হিসেবে তাকে সব খেলার অলরাউন্ডার বললে খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না।
যে খেলাটি খেলে এখন নামডাক সেই ক্রিকেটটাই বেশি ভালবাসতেন। স্থানীয় কোচ মোখলেসুর রহমানের জ্যোতিকে দিনাজপুর বিকেএসপিতে নিয়ে টেকনিক আর ট্যাকটিকসে শাণিত করেছেন। সিলেট বিভাগীয় দল, ক্রিকেট কোচিং ক্লাব (সিসিএস), ইয়াং গার্লস, গুলশান ইয়ুথ ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, খেলাঘর ক্রীড়া সংঘে নিজেকে প্রমাণ করে এখন তিনি জাতীয় দলের অধিনায়ক। জ্যোতির নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো বাছাইপর্বের গন্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল পেয়েছে ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার টিকিট। শুধু বাংলাদেশ নয়, মেয়েদের ওয়ানডে ইতিহাসেই এক ইনিংসে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ তিনটি স্টাম্পিংয়ের রেকর্ডও গড়েছেন জ্যোতি। টি-টোয়েন্টিতে দেশের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরিটিও তার।
২০১৯ সালে এসএ গেমস ক্রিকেটে মালদ্বীপের বিপক্ষে খেলেছিলেন হার না মানা ১১৩ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস। তাঁর বান্ধবী ফারজানা হক সেই ম্যাচে আবার অপরাজিত থাকেন ১১০ রানে। দুজনের অবিচ্ছিন্ন ২৩৬ রানের জুটি টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে তৃতীয় উইকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। শেরপুর থেকে ফুটবলে আতিকউজ্জামান খান খেলেছেন জাতীয় দলে। প্রিমিয়ার লিগে রহমতগঞ্জের অধিনায়ক মাহমুদুল হাসান কিরণও জ্যোতির জেলার মানুষ। করোনাকালে যখন সবকিছু বন্ধ তখন মাছ ধরার জাল টাঙ্গিয়ে অনুশীলন করতেন। খেলাটির প্রতি তার নিবেদনই আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে।