একটা স্বপ্নযাত্রার পথ অঙ্কিত হচ্ছিল। কিন্তু অন্তিম মুহূর্তে এসে সে পথ বেঁকে গেল। খুব কাছে গিয়েও সকল ভাবনা, আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণতার আবেশে ঘিরে ধরলো। পাকিস্তানের বিশ্বজয় হল না। মেলবোর্নের মহারণে ৯২ এর সেই পুনরাবৃত্তিও তাই এবার ঘটলো না। তিন দশক আগের সেই গ্রাহাম গুচদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল জশ বাটলারের ইংল্যান্ড।
পুনরাবৃত্তি হয়নি। কিন্তু কাকতালীয় ঘটনা কি আর পিছু ছাড়ে! সেবারের ফাইনালের শুরুটা হয়েছিল নো বল দিয়ে, আর এবারের ফাইনালটাও শুরু হয় নো দিয়ে। সেবারে প্রথম উইকেটের পতন হয়েছিল পঞ্চম ওভারে, এবারও ঠিক পঞ্চম ওভারেই। কিন্তু ফলটা তো হল ভিন্ন ৷ আর সেই ভিন্নতায় এবারের ফাইনাল পাকিস্তানকে ফিরিয়ে আনলো সেই ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের স্মৃতিতে।
সেবারের বিশ্বকাপে হট ফেবারিট দুটি দল অস্ট্রেলিয়া আর পাকিস্তান। ফাইনালেও উঠলো সেই দুটি দল। ধুন্ধুমার এক ফাইনালের অপেক্ষায় পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। ওয়াসিম, ওয়াকার আর ওয়ার্ন, ওয়াহদের মত গ্রেটদের লড়াই বাড়তি উত্তেজনা থাকবে-সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু দর্শকদের সে উচ্ছ্বাস, উন্মাদনায় গুড়ে বালি। বিশ্ব ক্রিকেট সাক্ষী হল বিরক্তিকর নিরস একটি ফাইনালের। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ১৩২ রানেই অলআউট হয়ে যায় পাকিস্তান। আর এমন লক্ষ্যকে এক পেশে লড়াই বানিয়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। ২ উইকেট খরচায় মাত্র ২০.১ ওভারেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় স্টিভ ওয়াহর দল।
২১ বছর আগের সেই ফাইনালের মত পাকিস্তান এবারের ফাইনালেও আটকে গিয়েছিলে ১৩০ এর ঘরে। প্রথম ব্যাট করে সর্বসাকুল্যে তুলতে পারে ১৩৭ রান। ৯৯ এর সেই ফাইনালে শেন ওয়ার্নের স্পিন ঘুর্ণিতে বিধ্বস্ত হয়েছিল পাকিস্তানি ব্যাটাররা। আর মেলবোর্নে এবার পাকিস্তানের বিপক্ষে শেন ওয়ার্ন রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন লেগস্পিনার আদিল রশিদ। পাকিস্তানের টপ অর্ডারকে একাই ধসিয়ে দেন তিনি। আর নিজের তৃতীয় ওভার করতে এসে আদিল রশিদ যে মেডেনটি করলেন, তর্ক-সাপেক্ষে সেটিই সম্ভবত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা ওভার। টপস্পিন, সাইড স্পিন, কী ছিল না সেই ওভারে!
আদিল রশিদের স্পিন ঘূর্ণিতে ৯৯ এর ফাইনাল স্মৃতিতে ফিরে আসলেও এবারের ফাইনালের লড়াইটা কিন্তু এক পেশে হয়নি। এক ওভার হাতে রেখে ইংল্যান্ডরা জিতেছে ঠিকই। কিন্তু ইংলিশদের ৫ উইকেটের এ জয়টা মোটেই কোনো নিরস ফাইনালের নমুনা ছিল না।
স্বল্প রানেই লড়াইটা জমিয়ে রেখেছিল পাকিস্তানের পেসাররা। তবে শেষ দৃশ্যের নায়কোচিত মুহূর্তটা তোলা ছিল বেন স্টোকসের জন্য। শাহীন, নাসিমদের একের পর এক বাউন্সার আর গতিতে ইংলিশ ব্যাটারদের মধ্যে একাই ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্টোকসই। উইনিং রানটা এসেছে তাঁর ব্যাট থেকেই। আর এবারের ফাইনালের একমাত্র ফিফটিটাও এসেছে স্টোকসের উইলো থেকে।
২০১৯ এর ওয়ানডে বিশ্বকাপে পর ২০২২ এ আবার বিশ্বজয়। তবে এবারেরটা ক্রিকেটের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম সংস্করণে। ইংল্যান্ড এর আগেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল। ২০১০ সালে প্রথমবারের মত শিরোপা জিতেছিল পল কলিংউডের ইংল্যান্ড। আর এক যুগ পর দ্বিতীয় বারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেল ইংলিশরা। ইংল্যান্ড বাদে শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজেরই একাধিকবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি আছে।
এদিকে, এশিয়া কাপের পর বিশ্বকাপেও রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল বাবর আজমের পাকিস্তানকে। একই সাথে, ৯২ এর পুনরাবৃত্তি ঘটানোর যে স্বপ্নে বিভোর ছিল সমগ্র পাকিস্তান, সেই স্বপ্ন তাদের জন্য হয়ে রইল শুধু সীমাহীন আক্ষেপ, আফসোসের প্রতিশব্দ।
আর সেবারের গ্রাহাম গুচদের হার এবার রূপ নিল জশ বাটলার, স্টোকস স্যাম কারানদের জয়ে। তিন দশক বাদে পাল্টেছে অনেক কিছু, পাল্টেছে ইংল্যান্ড ক্রিকেটও। ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়। সাদা বলের ক্রিকেটে সেরা দলটা তাই এখন উচ্ছ্বাস, উন্মত্ততায় ভেসে যেতেই পারে।