ফোন হাতে নূর আহমাদ অলস সময় কাটাচ্ছিলেন। ঠিক এই সময় টুইটারের পর্দায় মেলবোর্ন রেনেগেডসের একটি বার্তা ভেসে উঠলো। সেখানে তিনি লেখা দেখলেন ‘আমরা শীঘ্রই নূর আহমাদকে রেনেগেডসের হয়ে খেলতে দেখতে যাচ্ছি। তিনি এবারের বিগব্যাশে তাঁর পদচিহ্ন রাখতে চলেছেন।’
১৫ বছর বয়সের এই আফগান ৪১ বছর বয়সী ইমরান তাহিরের সাথে বিগব্যাশের দশম সংস্করণে একই সাথে ড্রেসিং রুম ভাগাভাগি করবেন, এমন খবর এই আফগান স্পিনারের কাছে বিষয়টি অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়েছিলো। কিন্তু কিছুদিন ধরে নুর আহমাদকে নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে যে জোয়ার চলছে তাতে একে খুব একটা বিষ্ময়কর ঘটনা বলা যায় না। কারণ ১৪ বছর বয়সেই তিনি আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে অনুশীলন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। যদিও নিলামের সময় কোন ফ্রাঞ্চাইজি এই বাহাতি স্পিনারকে দলে নেয়নি। এবারের ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে সেন্ট লুসিয়ার হয়ে তার অভিষেক হবার কথা ছিলো কিন্তু ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়।
বিভিন্ন ফ্রাঞ্চাইজির নজরের থাকার কারণে তিনি যে শীঘ্রই কোন দলে ডাক পাবেন এ ব্যাপারটি সহজে অনুমেয় ছিলো। ক্রিকেট বিষয়ক গণমাধ্যম ক্রিকবাজকে এক বার্তায় তিনি বলছিলেন, ‘এত অল্প বয়সে বিগব্যাশের মত প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবো বলে আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করছি। আমার উপর বিশ্বাস রাখায় আমি ফ্রাঞ্চাইজের সকলের কাছে কৃতজ্ঞ। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি এত শীঘ্রই এই সুযোগ পাবো। আমি এমন কিছুরই অপেক্ষায় ছিলাম যেখান থেকে নতুন কিছু শিখতে পারবো।’
নুর আহমদ বেশ আত্মবিশ্বাস সাথে নিয়েই বিগব্যাশে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন। তিনি সতীর্থ মুজিব-উর-রহমানের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছেন এবং তার দলেই আছে সাবেক আফগান অধিনায়ক অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার মোহাম্মদ নবী। তিনি বলেন, ‘বিগব্যাশে খেলা বেশ কঠিন। উপমহাদেশের পরিবেশের সাথে অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশের বেশ তফাৎ রয়েছে। এছাড়াও এখানে প্রতিপক্ষরাও বেশ কঠিন। তারা যেকোন সময় আপনাকে কঠিন পরীক্ষার সামনে ফেলতে পারে। কিন্তু বিগব্যাশের বাকি আফগান ক্রিকেটারদের ফলাফল আমাকে আত্মবিশ্বাসের যোগান দিচ্ছে।’
নুর আহমাদ বলছিলেন, ‘আমি মুজিব ভাইয়ের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছ। তিনি আমাকে সবকিছু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র লাইন-লেন্থের ব্যাপারে মনোযোগ দিতে বলেছেন যেটি সবজায়গায়তেই একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। আমি নিশ্চিত এবারের বিগব্যাশ আমার ক্রিকেট অধ্যায়ে প্রচুর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার জন্ম দিবে। আমি খুবই ভাগ্যবান যে নবী ভাইয়ের সাথে একই ড্রেসিং রুমে থাকবো। একইসাথে ইমরান তাহিরের কাছ থেকে নতুন কিছু শেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।’
নুরের জন্য আলোর নিচে আসাটা নতুন কিছু নয়।
ভারতীয় অনুর্ধ্ব ঊনিশের বিপক্ষে নুর আহমদ আফগান অনুর্ধ্ব ঊনিশের হয়ে পাঁচ ম্যাচের একদিনের সিরিজে ২০.৮৮ গড়ে নয় উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার ছিলেন এবং যেখানে তিনি ওভার প্রতি গড় রান দিয়েছেন মাত্র ৪.২৮। এমন চকমপ্রদ প্রদর্শনীর কারণেই তিনি রাজস্থান রয়্যালসের নজরে আসেন এবং তাদের কাছে অনুশীলন পরীক্ষার জন্য আমন্ত্রণ পান।
দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠেয় এবারের অনুর্ধ্ব ঊনিশ বিশ্বকাপে তিনি ওভার প্রতি মাত্র ৩.৯৩ রান দিয়ে সাত উইকেট নিয়ে আবার নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন। এরপরেই তিনি সেন্ট লুসিয়ার হয়ে খেলার ডাক পান। নুর বলেন, ‘ভারতে অনুষ্ঠিত পাঁচ ম্যাচের একদিনের সিরিজে আমিও দলে ছিলাম। সেখানে আমি খুব ভালো খেলেছি এবং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি উইকেট নিয়েছিলাম। রাজস্থান রয়্যালস থেকে আইপিএলের জন্য যখন আমাকে অনুশীলন পরীক্ষার জন্য ডাকা হয় তখন আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছিলাম। যদিও পরে কোন দলই আমাকে আর নেয়নি।’
আইপিএলের কোন দলের হয়ে ডাক না পাওয়ায় তার আফসোস আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি ‘আফসোস নেই’ বলে জবাব দেন। তবে তিনি সিপিএলের যেতে না পারার জন্য বেশ অনুতপ্ত বলে জানান যে শুধুমাত্র কপাল খারাপ বলেই সেখানে তিনি যেতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘আমি আইপিএল নিয়ে মোটেই অনুতপ্ত নই বরং আমাকে বোলিং নিয়ে আরও অনেক পরিশ্রম করতে হবে বলে মনে করি। তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় আমার পারফর্মেন্সের কারণেই আমি সেন্ট লুসিয়ার হয়ে ডাক পাই। এটি আমার জন্য বেশ ভালো একটি সুযোগ ছিলো। কিন্তু কোভিড-১৯ অতিমহামারীর কারণে সকল দূতাবাস বন্ধ থাকায় আমার আসলে কিছুই করার ছিলো না।’
নূর আহমাদ আফগানিস্থানের খোস্ত প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি আট ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। তিনি বর্তমানে একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন। দৈনিক কলেজে যাওয়া, ক্রিকেট খেলা ও জিমে যাবার পাশাপাশি নুর বিভিন্ন ধরণের অনলাইন গেমও খেলে থাকেন। তাঁর ভাই মোহাম্মদ নুরের কারণে তার মূলধারার ক্রিকেটে আসা।
তাঁর ভাই মোহাম্মদ নুর তার প্রতিভা আঁচ করতে পেরে তাকে স্পিনার হিসেবে একটি ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন বলে তিনি স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি সাধারণত কাচারি ঘরের সামনে আমার বড় ভাই মোহাম্মদ নূরের সাথে ক্রিকেট খেলতাম। আমার ভাইও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলেছেন। তিনি যখন খেলার প্রতি আমার আবেগ, ভালোবাসা ও প্রতিভা দেখতে পেলেন তখনই তিনি আমাকে ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হবার পরামর্শ দিয়েছিলেন।’
নুর তার এই স্বল্পদিনের ক্রিকেট অধ্যায়েই চমৎকার দক্ষতার সাথে সকলের নজর কেড়ে নিয়েছেন। যদিও তিনি বাকিদের মতই বিতর্কের উর্ধ্বে নন। তিনি অনুর্ধ্ব ঊনিশ বিশ্বকাপের কোয়ার্টারফাইনালে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ হুরাইরাকে ‘ম্যানক্যাড’ আউট করে করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। তবে তিনি এখন আর এ ধরণের আউট করতে চান না বলে জানান। কিন্তু তিনি বলেন যে ব্যাটসম্যান যাতে কোন বাড়তি সুবিধা না পান সে বিষয়ে তিনি সবসময় খেয়াল রাখবেন।
তিনি বলেন, ‘আইনানুযায়ী এটি আউট। কিন্তু ক্রিকেটের একজন ভক্ত হিসেবে বলবো এ ধরণের আউটের নিয়ম থাকা উচিত নয়। আমি আর কখনো এ ধরণের কাজ করতে চাই না। তবে আমি চাইবো ক্রিজের ননস্ট্রাইকিং পাশে যাতে কোন ব্যাটসম্যান বোলারে হাত থেকে বল ছাড়ার আগে যেনো সামনে না আগায়। যদি কেউ বল ছাড়ার আগেই সামনে যায় তবে আমি আম্প্যায়ারকে জানিয়ে তাকে সতর্ক করবো কিন্তু এখন থেকে আর আউট করবো না।’
নুর মূলত একজন চায়নাম্যান বোলার। অন্যান্য বাহাতি স্পিনারদের চেয়ে বোলিংয়ের সময় কিছুটা বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন বলে জানান। তিনি বলেন যে, অন্যান্য স্পিনাররা বল করার সময় প্রায়ই উইকেটে ব্যাটসম্যানের অবস্থান দেখতে পান না কিন্তু তিনি তার চায়নাম্যান স্টাইলের কারণে সহজেই ব্যাটসম্যানের অবস্থান দেখে বল করতে পারেন।
বিগব্যাশের মত প্রতিযোগিতায় জায়গা হবার কারণে নূর এখন নিজে আরও পরিণত করে সামনে এগোতে চান। সামনের জানুয়ারিতে ১৬ বছর বয়সে পা দিতে যাওয়া স্পিনার মাঠের পারফর্মেন্স দিয়ে সবকিছু অর্জন করতে চান। তিনি জানেন যে তাকে ভালো করতে হলে নিজেকে নিয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। তিনি বলেন, ‘বিগব্যাশ আমার জন্য ভালো একটি সুযোগ। আমি এ সুযোগের পরিপূর্ণ ব্যবহার করতে চাই। আমি যদি এখানে ভালো করি তবে আমি মনে করি আইপিএলসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন লিগ থেকে আমার ডাক আসবে।’
_______________
মূল লেখা: Noor Ahmad: The next Afghanistan spin prodigy in the making। অনুবাদ: সাজিদ মাহমুদ