জীবনকে দেখা হয় সিনেমার মত করে। জীননের ভাগ্যলিপির সাথে সিনেমার চিত্রনাট্যকে তুলনা করা হয়। ব্যাট বলের খেলা ক্রিকেট জীবনেরই একটা অংশ, জীবনের মতই। কিন্তু ক্রিকেটে কোন সিনেমা নেই, নেই স্ক্রিপ্ট। কি হতে যাচ্ছে সেটা কেউ জানে না দেখেই ক্রিকেট নিয়ে এতটা উন্মাদনা।
অনেকের কাছে ক্রিকেট বিনোদনের অংশ, কারো কাছে জীবিকা। আবার কেউ কেউ ক্রিকেটকেই বানিয়েছেন ধ্যান। কিন্তু চাঁদের যেমন কলঙ্ক আছে, তেমনি জীবনের সাথে মিশে থাকা ক্রিকেটেও লেগেছে কলঙ্কের দাগ। স্ক্রিপ্ট বিহীন খেলাটাতে দেখা গিয়েছে স্ক্রিপ্টের ব্যবহার। আর এই পুরো ব্যাপারটির নাম ফিক্সিং। ক্রিকেট ইতিহাসের কয়েকটি আলোড়ন তোলা ফিক্সিং সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
- হ্যান্সি ক্রনিয়ে
ক্রিকেট জগতের এক মহানায়ক ছিলেন হ্যান্সি ক্রনিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এই অধিনায়কের ক্রিকেট অঙ্গনে যেমন খ্যাতি ছিলো, তেমনি নেতিবাচক আলোচনায় আসেন ম্যাচ ফিক্সিং নিয়েও। লর্ডসে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ডের মধ্যকার বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে এক অদ্ভূত কাণ্ড করেছিলেন ক্রনিয়ে।
তিনি প্রতিপক্ষ অধিনায়ক নাসের হুসেইনকে প্রস্তাব দেন, ম্যাচের বাকি থাকা দুই সেশন ইংলিশরা ২৪৮ রান লক্ষ্যে ব্যাট করবে। উত্তেজনাকর ম্যাচে শেষপর্যন্ত দুই উইকেটে জিতেছিল স্বাগতিক দল। ক্রনিয়ের সাহসী সিদ্ধান্তের প্রশংসায় মেতে উঠেছিল ক্রিকেট বিশ্ব।
কিন্তু পরে জানা যায় এমন উদ্ভট প্রস্তাবের রহস্য। হ্যান্সি ক্রনিয়ের ম্যাচ ফিক্সিংয়ের তথ্য পায় ভারতের পুলিশ; ৫০০০ ইউরো এবং একটি লেদার জ্যাকেটের বিনিময়ে সেই ম্যাচটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন ক্রনিয়ে। পরে তাঁকে আজীবনের জন্য ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)।
- কাইউম প্রতিবেদন
হ্যানসি ক্রনিয়ের ঘটনার পরও থেকে থাকেনি ম্যাচ ফিক্সিং। ২০০০ সালে কাইয়ুম প্রতিবেদন প্রকাশের পর ম্যাচ ফিক্সিংয়ে পাকিস্তানি ক্রিকেটার সেলিম মালিক, আতাউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। শাস্তিস্বরূপ দুইজনকেই আজীবন ক্রিকেট থেকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। পাশাপাশি সেলিম মালিককে এক মিলিয়ন রুপি অর্থদন্ড দেয়া হয়েছিল।
এছাড়া ওয়াকার ইউনুস, ইনজামাম উল হক, সাঈদ আনোয়ারের মত কিংবদন্তিদেরও জরিমানা করা হয়েছিল সেবার। নিজের আত্মজীবনীতে শেন ওয়ার্ন বলেছিলেন ম্যাচ ফিক্সিং করার জন্য সেলিম মালিক তাকে ২,৭৬০০০ ডলার গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিল।
যদিও মালিক এমন অভিযোগ অস্বীকার করে। শেষ পর্যন্ত আপিলের মাধ্যমে ২০০৮ সালে ক্রিকেট থেকে নিজের আজীবন নিষেধাজ্ঞা তুলতে সক্ষম হন তিনি।
- মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন
সেলিম মালিকের সেই ঘটনার পর ভারতেও লেগেছিল ফিক্সিংয়ের হাওয়া। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনকে ফিক্সিংয়ের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত নিষেধাজ্ঞা ছিল এটি।
১৯৯৬ সালে কানপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তৃতীয় টেস্টে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্য কোনো এক জুয়াড়ির মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রনিয়েকে অর্থ দেওয়ার অভিযোগ উঠে আজহারউদ্দীনের বিরুদ্ধে। অনেক তদন্তের পর ২০০০ সালে তাকে ক্রিকেট থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করে আইসিসি।
আবার ১৯৯৮ সালের ভারতের সাবেক ক্রিকেটার মনোজ প্রভাকরের বিরুদ্ধে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠে। ভারতের সর্বোচ্চ ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই) এই অভিযোগ আনে। এতে ক্রিকেট অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনায় অজয় জাদেজা অভিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তাদের দুইজনকেই নিষিদ্ধ করা হয় ক্রিকেট থেকে।
- আমিরের নো-বল
ক্রনিয়ে বিতর্কের এক যুগ পর ক্রিকেট বিশ্ব আবার নড়েচড়ে বসেছিল। পাকিস্তানি তরুণ পেসার মোহাম্মদ আমির লর্ডস টেস্টে করে বসেন অবিশ্বাস্য নো-বল। আরো একটি ফিক্সিংয়ের অভিযোগ উঠে পাকিস্তান দলের বিরুদ্ধে। তদন্ত শেষে তৎকালীন অধিনায়ক সালমান বাট, ফাস্ট বোলার আমির এবং আসিফ দোষী প্রমানিত হন।
বিচারে সালমান বাটকে আজীবন এবং আসিফকে সাতবছরের জন্য ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। সতীর্থদের চেয়ে আগে নিজের দোষ স্বীকার করায় আমিরকে পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি জাতীয় দলের হয়েও খেলেছিলেন।
- ব্রেন্ডন টেলর
সর্বশেষ ফিক্সিং কাণ্ডে জিম্বাবুয়ের সাবেক উইকেট রক্ষক ব্যাটসম্যান ব্রেন্ডন টেলরের নাম জড়িয়েছে। অবশ্য তিনি ম্যাচ ফিক্সিং করেননি। টেইলর মূলত এক জুয়াড়ির কাছ থেকে উপঢৌকন গ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে একটি লিগ আয়োজনে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করে এই উপহার দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু আলোচনার এক পর্যায়ে টেইলর ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পান। কিন্তু আইসিসিকে এই ব্যাপারে দ্রুত না জানানোর কারনে তাকে একাধিক বছরের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আরো কিছু ফিক্সিং কাণ্ড রয়েছে যা শঙ্কিত করেছিল ক্রিকেট ভক্তদের।