ওল্ড-ট্র্যাফোর্ড, চিরন্তন আইরিশ

২০০৭-০৮ সাল। পুজোবার্ষিকীতে একটা গল্প বেরোলো ফুটবল নিয়ে। সেখানে একটি চরিত্র ছিল। রুনি। মফ:স্বলের ছেলে। রুনি ছিল স্কুল টিমের স্ট্রাইকার। ওর দাদা মিডফিল্ডার।যদিও গল্পের শেষে ছিল থ্রিলার, কিন্তু পুরো গল্পের পরিসর জুড়ে ছিল ফুটবল আর অদ্ভুতভাবে লতার মতো পরতে পরতে চিত্রনাট্যে পেঁচিয়ে থাকা হিরো,রুনি। সে বার আনন্দমেলায় সুপারহিট সেই গল্প।

সে সময়টা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্বপ্নের সময়। লাল বিপ্লবের সেই আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে সুদূর কলকাতাতেও ৷ মনে আছে আমাদের স্কুল টিমের জার্সি হল ম্যাঞ্চেস্টারের। কিন্তু ঝগড়া বাঁধল ১০ নম্বর কে নেবে এই নিয়ে। তখন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো সবে ডানা মেলছেন,মেসি পাপড়ি খুলছেন ইতিহাসের। কিন্তু ইংল্যান্ডের স্টার তখন একজনই।

রুনির জার্সি পরা অবশ্য সহজ ছিল না আমাদের, আজও নয়, গায়ে বড় হয় লাল ১০ নম্বর জার্সিটা। দেশ বদলায়, বদলায় সময় কিন্তু তবু ম্যানচেস্টারের ১০ নম্বর জার্সি খুঁজে পায় না চওড়া কাঁধ।

বক্সিং-এর পাঞ্চটা জোড়ালো হলেও তার রেশ থাকল না বেশিদিন। সকালে উঠেই গ্লাভস হাতে যে বস্তাটাতে হাজারে হাজারে পাঞ্চ মেরে যেত ছেলেটা সেটা কোন মন্ত্রবলে ফুটবলে পরিণত হল জানা নেই৷ এভার্টন ইয়ুথ একাডেমি থেকে যখন ডাক এল তখন বয়স নয়। তার আগে অবশ্যি লিভারপুল স্কুল টিমে ৭২ গোল করে শোরগোল ফেলে দিয়েছে ওয়ান্ডার কিড। বক্সিং প্র‍্যাকটিস শেষ করে ফুটবল।

তবে ফুটবলের পাঠটা একেবারেই ব্যকরণ বই মেনে ছিল না ছেলেটার। তার জীবন-আইকন তখন একজনই, রোনালদো নাজারিও দ্যা লিমা। মনে মনে যেন ঐ স্টেডিয়ামকে জাল কাঁপিয়ে উত্তাল করে দেবার স্বপ্ন পেয়ে বসেছে তাকে। পায়ে বল পেলেই গোল লক্ষ্য করে শট, মনে মনে বুঝে গিয়েছিলেন, ‘আমি রাজা হতে এসেছি, রাজা হয়েই যাবো’ – তাই হয়ত ছোট্ট থেকে ফুটবলের ব্যকরণ বই ভুলে তাঁর আদর্শ হয়েছিলেন রোনালদো, তার পায়ে লিখে দিয়েছিলেন সাফল্যের মন্ত্র।

এক যুগ। এক অধ্যায়। ওয়েন রুনিকে বেসবল প্লেয়ার বলে কটাক্ষ উড়ে এসেছে প্রেসবক্স থেকে। রাজেশ খান্নার মতো জামায় টোকা মেরে ছুঁড়ে দিয়েছেন তিনি সমস্ত কটাক্ষকে। দিনের শেষে শুধু স্কোরবোর্ড নয়, ওল্ড ট্র‍্যাফোর্ডের হাজার হাজার মনের সাদা পাতায় তিনি লিখে দিয়েছেন তাঁর নাম।

এভারটর থেকে ম্যানচেস্টারে বয়ে আসা এক নদী যেন ১৩ বছর ধরে গড়ে দিল সভ্যতা, বুকে করে নিয়ে আসা পলি দক্ষ জহুরি ফার্গুসনের স্বপ্নের ওল্ড ট্র‍্যাফোর্ডে গড়ে দিল ব্রিটিশ ফুটবলের ইমারত, সবচেয়ে বড় ইমারত, কত জন এলেন, চলে গেলেন, তাঁদের অসমাপ্ত গানের সঞ্চারীকে প্রাণ দিয়েছেন রুনি, প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোরার?

সে তো নিথর-নিস্প্রাণ স্ট্যাটিস্টিক্স, রাতের ওল্ড ট্র‍্যাফোর্ডের জ্বলে ওঠা আলো হতে পেরেছিলেন অনেকেই কিন্তু সেই আলো নিবে যাবার পরের নিস্তব্ধতাটুকুর নাম ওয়েন রুনি, ১৩ বছর অনন্ত লাল-প্রবাহের প্রতিটি হৃদস্পন্দনের নাম ওয়েন রুনি।

ইতিহাস নিষ্ঠুর তাই হয়ত ইতিহাস এত বর্ণময়৷ লিভারপুলের ক্রক্সটেথ জন্ম দিয়েছিল ম্যাঞ্চেস্টার কিংবদন্তীর, লাল জার্সি পরলেন দুজনেই। শুধু স্টিফেন জেরার্ডের সাথে অদ্ভুত সমাপতনের ইতিহাস লেখা হল না বলেই হয়ত প্রিমিয়ার লিগের আলো আরও উজ্জ্বল হল, আরও নিস্তব্ধতার ভেতর সময়ের স্বরলিপি হয়ে থাকল ফুটবল ইতিহাসের দুই মহারথী, নিভন্ত আলোয় চকচক করে ওঠা ওল্ড ট্র‍্যাফোর্ডের শেষ বাতিস্তম্ভের দিকে চেয়ে থাকলেন এক বিরহী আইরিশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link