ওল্ড ইজ গোল্ড, গোল্ড ইজ নেহরা
ক্যারিয়ারের গোড়ায় যে শিশু বিরাট কোহলির হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন, সায়াহ্নে এসে সেই কোহলিকেই পেয়েছেন অধিনায়ক হিসেবে। ১৮ বছরের লম্বা ক্যারিয়ার তাঁর। ভারতের ক্রিকেটের উত্থানপর্ব থেকে শুরু করে মহীরূহ হয়ে ওঠা - সবই দেখেছেন তিনি। ‘রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান’ বলেই শেষ দিনে স্বয়ং কোহলি তাঁকে কাঁধে নিয়ে সারা মাঠ চক্কর কেটেছেন।
এক নভেম্বর ২০১৭। ব্ল্যাক ক্যাপ ইনিংসের শেষ ওভারের আগের ওভার মানে ১৯ নম্বরটা। বুমরা লাইন আপে। অন্য একজনকে ‘জুম’ করলো টেলিভিশন ক্যামেরা।
তিনি একটু অবাক যেন। মাত্র দু’টো উইকেট বাকি যে! যদি বুমরা নিয়ে নেন। তবে আর বল উঠবে না তাঁর হাতে কোনো দিন।
সেই ওভারেই একটা জোরে গড়ানো শট এক নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যানের ।তিনি একটু দৌড়ে বলের লাইনে পৌঁছে গেলেন। তারপরেই ম্যাজিক। পা দিয়ে ছোট্ট টাচ দিলেন বলটায়। যেন কথা হয়ে গেল পা আর বলে। হাওয়ায় ভাসল বলটা। তিনি লুফে নিয়ে ছুঁড়ে দিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনিকে। সঙ্গে সেই অনাবিল হাসি। কি অনায়াসে যে ঘটে গেল ব্যাপারটা, লিখে বোঝান যায় না। টিভিতে দেখে গেলাম মুগ্ধ হয়ে।
ক্রিকেট দেবতাও চাইছিলেন, তিনি বল করুন শেষ ওভারে। করলেন। উইকেট পেলেন না। কিন্তু সেই হাসি আর সহজতা ছেড়ে গেল না তাঁকে জীবনের শেষ ওভারেও। এই ট্রেডমার্ক হাসি আর সহজ করে নেওয়া খেলা – জ্বি! এটাই আশিষ নেহরা।
১৯৯৯ সালে শুরু আন্তর্জাতিক ময়দানে খেলোয়াড়ী জীবনে ৫ বছর পরে, ২০০৪ এই শেষ টেস্ট খেলে ফেলা।১৭ টেস্টে ৪৪ উইকেট।
এরই ফাঁকে ২০০১ সালে একদিনের ক্রিকেটে অভিষেক। ২০০৩ সালের স্মরণীয় বিশ্বকাপে তাঁর বোলিং আজও চোখের সামনে। তার গতি আর সুইংয়ের কাছে নতজানু ছিল অস্ট্রেলিয়ার স্বপ্নের দল ছাড়া সবাই। সেবার না জেতার আক্ষেপ মেটে ২০১১ সালো বিশ্বকাপ জিতে। তাও চোটের জন্য সেবার ফাইনালের ফাইনাল টিমে ছিলেন না। ওই ২০১১ সালেই শেষ ‘একদিন’ খেলা। ১২০ ম্যাচে ১৫৭ উইকেটের পর।
সেই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে শেষ ম্যাচটা খেলেছিলেন সেমিফাইনালে, পাকিস্তানের বিপক্ষে। মোহালিতে সেদিন ৩৩ রান দিয়ে ১০ ওভারে পেয়েছিলেন দুই উইকেট। অথচ, সেটাই তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে হয়ে রইলো।
টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয়েছিল ২০০৯ সালে। রূপকথার ‘কামব্যাক’ ২০১৬ সালে কুড়িবিশ বিশ্বকাপে। সেটা চললো বছর দুয়েক, খেললেন ২০১৭ সাল অবধি। ২৭ ম্যাচে ৩৪ উইকেটের পুঁজিতে।
ক্লাসিকাল বাঁ-হাতি পেসারের সকল গুনাবলীই তাঁর মধ্যে ছিল। পেস, অ্যাকুরেসি, বৈচিত্র, লাইন-লেন্থ, বলের মুভমেন্ট আদায় করে নেওয়া – সবই জানতেন। বিপজ্জনক লেট ইনসুইঙ্গারগুলো দিয়ে ব্যাটসম্যানদের হরহামেশা বিপদে ফেলতেন। ইনজুরি তাঁর ক্যারিয়ারের পথে বাঁধা হয়েছে বটে – কিন্তু তাঁকে দমাতে পারেনি। তিনি ফিরেছেন, বুড়ো বয়সেও ভেলকি দেখিয়েছেন।৩৭-৩৮ বছর বয়সে একজন পেসারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেলাটা কোনো ‘ফাজলামো’ নয়।
তিনি বরাবরই ‘ওল্ড স্কুল’ মতধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। ২০১১ বিশ্বকাপ খেলতে যখন বাংলাদেশে, তখন বলেছিলেন, নোকিয়ার ফিচার ফোনেই তাঁর ভরসা। স্যোশাল মিডিয়ায় সরব হওয়া তাঁর ধাঁচে নেই। ক্যারিয়ারেও তিনি ‘ওল্ড স্কুল’ই ছিলেন। কোনো শর্ট কাট নয়, বরং বিশ্বাসী ছিলেন পরিশ্রমে। তাই তো যত পুরনো হয়েছেন – ততই মুগ্ধ করেছেন।
ক্যারিয়ারের গোড়ায় যে শিশু বিরাট কোহলির হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন, সায়াহ্নে এসে সেই কোহলিকেই পেয়েছেন অধিনায়ক হিসেবে। ১৮ বছরের লম্বা ক্যারিয়ার তাঁর। ভারতের ক্রিকেটের উত্থানপর্ব থেকে শুরু করে মহীরূহ হয়ে ওঠা – সবই দেখেছেন তিনি। ‘রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান’ বলেই শেষ দিনে স্বয়ং কোহলি তাঁকে কাঁধে নিয়ে সারা মাঠ চক্কর কেটেছেন।
সহ-খেলোয়াড়রা যে সম্মান জানিয়ে তাকে বিদায় দিয়েছিলেন, তা অনেক মহাতারকাও পাননি ভারতীয় ক্রিকেটে। লড়াই আর চেষ্টাটাই নেহরার জন্য স্থায়ী আসন পেতে রাখতে বাধ্য ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে।