মেলবোর্নে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের ম্যাচ। জেতার পথেই আছে বাবর আজমের দল। কিন্তু প্রায় জিততে থাকা ম্যাচটা হঠাতই বিরাট কোহলির শেষের ঝলকে হেরে গেল পাকিস্তান। এমন হারের পর গোটা পাকিস্তান দলটা যেন হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়লো। মেলবোর্নের সেই দৃশ্য দূর শহর পেশোয়ার থেকে দেখলেন এক তরুণ। নিজ দেশের এমন অপ্রত্যাশিত হারে মুষড়ে পড়লেন তিনিও। সেই তরুণের নাম মোহাম্মদ হারিস।
ঘটনাটা এই বিশ্বকাপেরই। মোহাম্মদ হারিস পাকিস্তানের বিশ্বকাপ দলে ছিলেন না। তবে মেলবোর্নের যে দুঃখ গাঁথায় ভেসে গিয়েছিলেন তিনি, সেই হারিসই আবার মেলবোর্নের ফাইনালে খেলতে যাচ্ছেন। সপ্তাহ দুয়েকের মাঝেই জীবনের অন্যরকম এক বাঁক দেখে নিলেন মোহাম্মদ হারিস। নিশ্চিতভাবেই স্বপ্নিল এক সময় পার করছেন তিনি।
সুপার টুয়েলভে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচের আগেও ফিট নন ফখর জামান। পুরনো ইনজুরিতে থেকে বেরই হতে পারছিলেন এ বাঁহাতি ব্যাটার। পাকিস্তান টিম ম্যানেজমেন্টও তাই খোঁজা শুরু করলো বিকল্প। আর সেই ভাবনায় পেশোয়ার থেকে উড়িয়ে আনা হলো এই মোহাম্মদ হারিসকে। টেলিভিশনের পিছনে এই টুর্নামেন্টের দর্শকের ভূমিকায় থাকা হারিস হঠাতই হয়ে গেলেন বিশ্বকাপ স্কোয়াডের সদস্য।
ছিপছাপ গড়নের ডান হাতি টপ অর্ডার ব্যাটার হারিস। আগের পিএসএলেই দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটিয়েছেন। পেশোয়ার জালমির হয়ে ৫ ম্যাচে করেছিলেন ১৬৬। তবে সব কিছু ছাপিয়ে তাঁর স্ট্রাইকরেটটা ছিল দেখার মতো, ১৮৬.৫২! পাকিস্তানের টপ অর্ডারেও এই একই সমস্যা।
কোনো টপ অর্ডার ব্যাটারই তেমন বিধ্বংসী রূপে শুরু করেন না। পাকিস্তানের ইনিংসও তাই এগিয়ে যেতে থাকে মন্থর গতিতে। সে জন্যই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচেই একাদশে নামিয়ে দেওয়া হলো হারিসকে। আর টিম ম্যানেজমেন্টের এই এক সিদ্ধান্তেই পাল্টে যায় পাওয়ার প্লে তে পাকিস্তানের চিরায়ত চিত্র।
বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচ। কিন্তু স্নায়ুচাপের সামান্য ছাপও যেন নেই তাঁর মধ্যে। রাবাদার বিপক্ষে খেলতে নেমেই প্রথম দুই বলে দুই ছক্কা। এরপরে নর্কিয়ার বলে স্কুপ মেরে ছক্কা। এতেই ১০ বলে ২৮ রান তুলে ফেলেন মোহাম্মদ হারিস। হারিসের সেই ইনিংসটা ২৮ রানেই আটকে যায়। কিন্তু ছোট্ট ইনিংস স্বত্ত্বেও রাবাদা, নর্কিয়াদের মতো বোলারদের বিপক্ষে আগ্রাসনে বিশ্ব ক্রিকেটের মাঝে এক ধরনের বিস্ময়ই সৃষ্টি হতে শুরু করে। বিশেষত, এমন গড়নের একজন ব্যাটারের ক্লিন হিটিং সক্ষমতা দেখলে অবাক হতেই হয়।
মোহাম্মদ হারিস তাঁর এমন রূপ পরবর্তী ম্যাচ গুলোতেও দেখিয়েছেন। কোনো ইনিংসই তেমন বড় নয়। তবে যতক্ষন খেলেছেন, বোলারদের মনে ভয় ধরিয়ে গেছেন। আর এমন ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ের কারণেই টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়েছেন মোহাম্মদ হারিস। ফাইনালের আগেও চোখ থাকছে তাঁর উপর। অনেকের মতে, পাকিস্তানের এমনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এক্স ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে দলে হারিসের সংযুক্তি।
পাকিস্তানের হয়ে খেলার আগে থেকেই মোহাম্মদ হারিসকে মিস্টার গুগল বলে ডাকা হতো। সতীর্থদের থেকেই পেয়েছিলেন এমন নাম। মূলত সবকিছুতে জানার ইচ্ছা আর নিজের মাঝে সেটা ধারণ করার জন্যই তাঁকে এমন নামে ডাকা হতো। মিস্টার গুগল ডাকনামের নেপথ্যে মোহাম্মদ হারিস নিজেও জানিয়েছেন তাঁর গল্প। তিনি বলেন, সবকিছুর জন্য আমার একটা উত্তর আছে। আমি সব বিষয়েই নিজেকে আপডেট রাখার চেষ্টা করি।
হারিসের এমন তথ্য অণ্বেষণের নেশাটা এসেছিল মায়ের অনুপ্রেরণাতে। আর সেই মায়ের অনুপ্রেরণাতেই তাঁর ক্রিকেট আঙিনায় প্রবেশ। নিজের পড়াশোনা ঠিক রেখে হারিস চালিয়ে গিয়েছিল ক্রিকেটও। খুব অল্প সময়ের মাঝে সুযোগ পান পেশোয়ারের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে, এর কিছু দিন বাদে পাকিস্তানের অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও সুযোগ মিলেছিল। সেই পরিক্রমায়, ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পান হারিস।
হারিসের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে বড়সড়ো পরিবর্তন আসে পিএসএলে দল পাওয়ার পর। প্রথম আসরেই নিজের সক্ষমতা দেখান তিনি। ৩৩ বলে ৭০ রানের একটি ইনিংস খেলে নিজেকে হঠাতই আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। সুযোগ পান ঘরের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজেও। তবে বিশ্বকামগামী দলে শেষ পর্যন্ত আর জায়গা হয়নি তাঁর।
ভাগ্যের কী লীলা খেলা! বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়ে ব্রাত্য হওয়া সেই হারিসই বিশ্বকাপ দলে পরবর্তীতে ঢুকলেন। আর দলে ঢুকেই আবারো নিজেকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে গেলেন। প্রতিটা ম্যাচেই খেললেন চোখ জুড়ানো দারুণ সব শট। আর সবকিছু ছাপিয়ে, সবার মনযোগ আকর্ষণ করলো, তাঁর ভয়ডরহীন ব্যাটিং এপ্রোচ।
মোহাম্মদ হারিসের এমন ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ের রহস্য কি? মোহাম্মদ হারিস সেই রহস্যের উন্মোচন করতে গিয়ে জানালেন, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসই তাঁকে এমন এপ্রোচে ব্যাটিং করতে সহায়তা করে। এমনকি কাউকে অনুকরণও তিনি করতে চান না। তিনি নিজে যেটা, সেটা নিয়েই এগিয়ে যেতে চান ক্রিকেটে।
রাবাদা, নর্কিয়াদের মতো বোলারের বিপক্ষে প্রথম দেখাতেই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং। সেটির নেপথ্যেও কি হারিসের শুধু আত্মবিশ্বাসই লুকিয়ে আছে। আত্মবিশ্বাস তো বটেই, তবে হারিস নিজেও আলাদা একটা ভাবনাকে অবলম্বন করে চলেন। কী সেই ভাবনা? বোলার কে, সেটা মূখ্য নয়, বলের লাইন দেখে ব্যাট চালাতে হবে। আর প্রত্যেক বোলারকেই আক্রমণ করার দৃঢ় মানসিকতা থাকতে হবে।
হারিস বিশ্বকাপ স্কোয়াডে সুযোগ পেলেন। তখনও তাঁকে নিয়ে ক্রিকেট বিশ্ব সরব হয়নি। কারণ তখন পর্যন্ত কোনো ম্যাচে মাঠেই নামেননি তিনি। এর মাঝেই দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটার শাদাব খান বললেন, হারিস ব্রিলিয়ান্ট। ও যদিও এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পারফর্ম করেনি। তবে ওর সক্ষমতা আছে। আমরা তাঁকে দলে পেয়ে খুব খুশি।
হারিসের সংযুক্তিতে শুধু শাদাবই প্রশংসায় ভাসাননি, স্কোয়াডে থাকা শান মাসুদ, আসিফ আলী, হায়দার আলিরাও উচ্ছ্বসিত মন্তব্য করেছিলেন হারিসকে নিয়ে। বিশ্বকাপে নিজের অভিষেকের আগে তাই সতীর্থদের পাশে পেয়েছিলেন মোহাম্মদ হারিস।
আর সবচেয়ে প্রশংসাটা তো পেয়েছিলেন অধিনায়ক বাবর আজমের কাছ থেকে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে বাবর আজম বললেন, হারিসকে দেখে মনেই হচ্ছে না, এটা তাঁর প্রথম বিশ্বকাপ। একদম সত্যিকার অর্থেই তাই। খুব বেশি কিছু করে ফেলেননি। কিন্তু এর মাঝেই নিজের দ্যুতিটা অন্তত দেখাতে পেরেছেন।
কতশত ম্যাচজয়ের নায়কদের ভীড়ে আড়ালে চলে যায় পার্শ্বনায়করা। কিন্তু মোহাম্মদ হারিসের ক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক উল্টোটা। নায়ক নন, প্রধান পার্শ্বনায়কও নন, কিন্তু একটা চরিত্র হিসেবে সবার মনযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছেন। মেলবোর্নের আগামী মহারণেও সেই চরিত্র জুড়ে থাকবে সবার মনযোগ।
নিজেকে এমন কেন্দ্রিভূত করার উৎসবের শেষটাও তাই রাঙাতে চাইবেন মোহাম্মদ হারিস। তবে এবারের অপেক্ষাটা শুধু একটা চরিত্রের জন্য নয়, একজন নায়ক হিসেবে দেখার অপেক্ষায়। কারণ নতুনত্বের জয়গান সর্বত্র্য, সবখানে।