সে ১৯৯০ সালের ঘটনা। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে স্কুলশিক্ষক ব্রায়ান স্টার্লিংয়ের ঘরে জন্ম নেয় এক শিশু। বাবা তাঁর নাম রাখেন পল স্টার্লিং।
সদ্যজাত শিশুর ভবিষ্যৎ দেখার সুযোগ নেই, থাকলে হয়তো আইরিশ রূপকথার এক নায়কের জন্ম নেওয়া বেশ ঘটা করেই পালন হত পুরো আয়ারল্যান্ড জুড়ে। তা সেটা না হলেও সেদিনের পল কিন্তু আয়ারল্যান্ডবাসীকে ঘটা করে উদযাপনের সুযোগ এনে দিয়েছেন এরপর অনেকবার!
বাবা ব্রায়ান স্টার্লিং পেশায় ছিলেন স্কুলশিক্ষক, সে তো আগেই বলেছি। তবে বেলফাস্টের ঐ স্কুলশিক্ষকের রক্তে কিন্তু ছিল ক্রিকেট আর রাগবি। স্কুলজীবন থেকেই খেলেছেন ক্রিকেট। রাগবিতেও ছিলেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের রেফারি। বাবার কথা তো হল, বড় ভাইয়ের কেচ্ছাটাও শোনাই একটু। তিনি তো আয়ারল্যান্ডের হয়ে ২০০৫-০৬ এর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও খেলেছেন।
মোটা দাগে, পল স্টার্লিং জন্মেছিলেনই এমন এক পরিবারে ক্রিকেটকে যেখানে রীতিমত ভক্তির সাথে মান্য করা হয়। সেই মান্যতা আস্তে আস্তে জুড়ে গেছিল স্টার্লিংয়ের রক্তেও। বাবা আর ভাইকে দেখে খুব অল্প বয়সেই ক্রিকেটকে ভালবেসে ফেলেছিলেন পল স্টার্লিং। ব্যাট আর বল হাতে নিয়ে নেমে পড়েছিলেন ক্রিকেটতীর্থের পাশের দেশেই। কিন্তু, আয়ারল্যান্ডে এমন ক্রিকেট প্রেমের প্রতিদান কে দেবে!
আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এসব দেশের ক্রিকেটারদের ইংলিশ দলে খেলার একটা সুপ্ত ইচ্ছে সবসময়ই থাকে। সেই ইচ্ছে কখনও পূরণ হয়, কখনও হয়না। তবে তা পুরণ না হলেও বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায়, এসব দেশের ক্রিকেটাররা অন্তত কাউন্টি ক্রিকেট অব্দি দৌড়ঝাপ করেন। পল স্টার্লিং এর ক্ষেত্রেও সেরকম বাঁধাধরা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটবে, এমনটা ভাবারও কোন কারণ নেই। এউইন মরগানের পিছ ধরে তিনিও খেলেছেন কাউন্টি ক্রিকেটে। তবে সেই গল্পে একটু ভিন্নতা আছে, তা নামটা যখন পল স্টার্লিং তা না থাকলে কি আর চলে?
সাধারণত যেটা হয়, ইংল্যান্ড আর তাঁর আশেপাশের দেশের ক্রিকেটারদের আগে কাউন্টি ক্রিকেটে অভিষেক হয় আর এরপর তারই সূত্র ধরে জাতীয় দলে ডাক পড়ে। সেই ডাক সবসময়ই যে নিজের দেশেই হয় এমনটাও নয়, অতিমানবীয় পারফর্ম করতে থাকলে তাকে ছোঁ মেরে তুলে নেয় ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ড। স্টার্লিংয়ের গল্পের ভিন্নতা এখানেই, ফ্লেভার বদলে এই গল্পে আগে এসে গেছে জাতীয় দল এরপর কাউন্টি!
মার্চ, ২০০৮: আয়ারল্যান্ডের হয়ে যখন ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেক হচ্ছে পল স্টার্লিংয়ের। তখন মিডলসেক্সের মূল দলের হয়ে তিনি ট্রেনিং গ্রাউন্ডেও যাননি। তবে মিডলসেক্সে তাকে রাডারে রেখে দিয়েছে, যুবদলের হয়ে বেশ কিছু ম্যাচও পরখ করেছে বলে শোনা যায়। তবে তা ঐ পরখটুকুই, আইরিশ এক ক্রিকেটারকে এত অল্প বয়সে সুযোগ দিতে মিডলসেক্সের তো বয়েই গেছে!
নাহ, তা বয়ে না গেলেও তা করতে কিন্তু একসময়ই বাধ্য হয়েছে মিডলসেক্স। ২০০৮ এর পর ২০০৯ এর গল্পটা তাঁর আগে সেরে নিই। জুলাইয়ের সে ম্যাচে পল খেলতে নেমছিলেন আইসিসির ইন্টারকন্টিনেন্টার কাপ। জার্মি ব্রেকে সাথে নিয়ে ওপেন করতে নেমে সেদিনই প্রথমবারের মত বড় মঞ্চে নিজেকে চিনিয়েছেন তিনি, প্রথম ইনিংসেই করেছিলেন কাঁটায় কাঁটায় একেবারে ১০০!
নিজেদের রাডারে থাকা অল্পবয়সী টিনএজার পল স্টার্লিংয়ের সে ইনিংস কিন্তু মিডলসেক্সের নজর এড়াল না। কাউন্টি ঐ দলটা জুলাই পেরিয়ে ডিসেম্বরেই স্টার্লিংকে আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রস্তাব দিয়ে বসল। কি ভাবছেন? এটুকুই? নাহ, স্টার্লিংয়ের পোয়া বারো হবার তখনও বাকি আছে। মিডলসেক্স আয়ারল্যান্ডের সাথে চুক্তি করার পর আরেকটা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে হয় স্টার্লিংকে আর সেটা ছিল আয়ারল্যান্ড ক্রিকেটের গভর্নিং বডির আনুষ্ঠানিক চুক্তি।
এই মুহুর্তে এই শেষ লাইনটা হয়তো আপনার কাছে বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আপনি হয়তো ভেবে নিচ্ছেন, দুর্দান্ত পারফর্ম করা একজন ক্রিকেটার নিজের দেশের ক্রিকেট বোর্ডের চুক্তি পাবেন আর তাতে স্বাক্ষর করবেন এতে অবাক হবার কি আছে? হ্যা, অবাক হবার আছে। কারণ দেশটির নাম আয়ারল্যান্ড।
দেশটির ক্রিকেট দলে ঐ সময়ে যেসব ক্রিকেটাররা খেলতেন তাঁদের বেশিরভাগেরই মূল পেশা ক্রিকেট ছিল না। তাঁরা ক্রিকেটটা খেলতেন নিতান্তই ভাল লাগা থেকে। আর তাছাড়াও পল স্টার্লিংকে যখন চুক্তিভুক্ত করা হল সে সময়ে আয়ারল্যান্ড ক্রিকেট মাত্র ছয় জনকে আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিল। হ্যা, সংখ্যাটা মাত্র ছয় আর স্টার্লিং ঐ বয়সেই তাঁদের একজন!
২০১১ বিশ্বকাপ অব্দি মিডলসেক্স স্টার্লিংকে খেলিয়েছে কেবল লংগার ভার্শন দলে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে স্টার্লিংকে তাঁরা খুব বেশি গোণায় ধরেনি। কিন্তু সে দৃশ্যও বদলে গেল ২০১১ বিশ্বকাপের পর, যে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে রীতিমত রূপকথা লিখেছিল আয়ারল্যান্ড । সে বিশ্বকাপের পর লিস্ট-এ ক্রিকেটে অভিষেক হয় স্টার্লিংয়ের। আর এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি স্টার্লিংকে। এই কিছুদিন আগেই তো এউইন মর্গান বলে দিলেন, বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক আর আক্রমণাত্মক ওপেনার পল স্টার্লিং।
স্টার্লিং এর ক্যারিয়ারে অর্জন আছে বেশ অনেক। সে অর্জনের শুরু ২০১০ সালে, আইসিসি যখন তাকে ‘ইমার্জিং প্লেয়ার অফ দা ইয়ার’ ঘোষণা করে। সেই একই বছরই স্টার্লিং জিতে নেন সহযোগী দেশের খেলোয়াড়দের মধ্যে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটিও।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পরিসংখ্যানও সাক্ষ্য দিচ্ছে পল স্টার্লিংয়ের নানা অর্জনের। ওয়ানডেতে ৪০-এর কাছাকাছি গড় নিয়ে করেছে প্রায় পাঁচ হাজারের কাছাকাছি রান। স্ট্রাইক রেটও বেশ ভাল- ৮৫-এর ওপরে! এছাড়াও ক্রিকেটের সুদীর্ঘ ইতিহাসে মাত্র ১৩ জন ব্যাটসম্যান ২৩ বছরের আগে পাঁচ ওয়ানডে সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন, স্টার্লিং সেই ১৩ জনের একজন আর বাকি ১২ জনের মধ্যে কেউই আইসিসির সহযোগী দেশের সদস্য হিসেবে এই রেকর্ড করেননি।
ওয়ানডের চাইতে অবশ্য টি-টোয়েন্টি তেই বেশি আক্রমণাত্মক পল স্টার্লিং। অবশ্য আক্রমণাত্মক না বলে খুনে বলাটাই মনে হয় ঠিকঠাক শব্দচয়ন হবে। আর হবে নাই বা কেন বলুন তো? আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে কারো স্ট্রাইক রেট যদি ১৩৯ হয় তাহলে কি তাকে খুনে না বলে উপায় আছে?
খুব সম্ভবত এই স্ট্রাইক রেটের জন্যেই আজকাল নানা ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগে ডাক পাচ্ছেন তিনি। আফগানিস্তানের ঘরোয়া ফ্রাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে খেলেছেন কান্দাহারের হয়ে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) মাঠে নেমছেন খুলনা টাইটানসের হয়ে। এমনকি সদ্য শেষ হওয়া লঙ্কান প্রিমিয়ার লীগেও ডাম্বুলা ভাইকিংয়ের দলে ছিলেন তিনি!
যা হোক, আপনাদের কি মনে হয়েছে এতকিছু ছেড়ে হঠাৎ পল স্টার্লিংকে নিয়ে কেন লিখতে বসলাম? কারণ, স্টার্লিং তাঁর খেলা শেষ ছয় ওয়ানডের চারটিতে সেঞ্চুরি করেছেন! হ্যা ভুল শোনেননি, শেষ ছয় ওয়ানডের চারটিতেই!
যার শেষ দুটি আবার আফগানিস্তানের বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে। রশিদ, মুজিব আর নবি – এই স্পিনত্রয়কে খেলা এখন যেকোন কন্ডিশনেই বেশ কঠিন। পল স্টার্লিং শুধু এই কঠিন এই কাজটি করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি রীতিমত এদের ব্যাটের তুবড়িতে উড়িয়ে দিয়েছেন। শেষ দুই ম্যাচে করেছেন পরপর দুটি সেঞ্চুরি- ১২৮ আর ১১৮। সেঞ্চুরিতে স্টার্লিংয়ের দাপট তাঁর স্ট্রাইক রেট দেখলেই বুঝে ফেলার কথা – প্রথম সেঞ্চুরিতে ৯৬.৯৭ আর দ্বিতীয়টিতে ৯৯.১৬!
পল স্টার্লিংরাই আসলে ক্রিকেটের সৌন্দর্য। একজন সহযোগী দেশের ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠা, দেশকে তুলে ধরা, এরপর পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়া- স্টার্লিংয়ের জীবনের গল্পটাও ক্রিকেটের ঐ সৌন্দর্যের মতই সুনিপুণ। স্টার্লিং জন্ম নিয়েছেন যে আয়ারল্যান্ডে, সে দেশের আইরিশ মিথোলজিতে অ্যানগাসকে বলা হয় প্রেম, যুবা আর কাব্যের দেবতা। আপাতত আমরা অ্যানগাসকে পাচ্ছিনা। তবে ব্যাট হাতে নামা স্টার্লিং তো আয়ারল্যান্ড ক্রিকেটের অ্যানগাসই।