ফুটবলের অবিসংবাদিত রাজা

স্যার ডন ব্র‍্যাডম্যানের নাম শুনেছেন? ক্রিকেট নিয়ে একটু ধারণা থাকলে এই ভদ্রলোকের নাম শোনারই কথা।বলা হয়ে থাকে তিনিই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান। তাঁর সময়ে কি আর ভাল কেউ খেলতেন না ?ওনার সময়ে কি তাঁর যোগ্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না? একটু ভাল করে খোঁজ নিলে জানা যায় সেই সময়েও আরও অনেক ভাল খেলোয়াড় ছিলেন।কিন্তু এদের অনেকের নাম নিলেও আমরা তাদের চিনতে পারবো না।

মোহাম্মদ আলীর নাম শুনেছেন? বক্সিংয়ের কথা বললে যার নাম চোখের সামনে ভেসে আসে। কারও যদি বক্সিং খেলা সম্পর্কে কোনো ধারণাও না থাকে, তবুও আলীর নাম অন্তত শুনেছেন।

অন্যান্য খেলার তুলনায় ফুটবল অনেক বেশি জনপ্রিয়। এমনকি জাতিসংঘের সদস্যের চেয়ে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফিফার সদস্য সংখ্যা আরও বেশি। তবে পৃথিবীতে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে এখনও অনেকে ফুটবল খেলাটা সম্পর্কে তেমন জানে না। অবিশ্বাস্য মনে হলেও বিষয়টা সত্য। ১৯৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবল বিশ্বকাপ হচ্ছিল।

জরিপ করে জানা গিয়েছিল, সেখানকার মাত্র ৩৬% মানুষ জানতো যে ফুটবল বলে একটা খেলা আছে, এর মাঝে ১০% মানুষ জানতো যে বিশ্বকাপ ফুটবল বলে একটা টুর্নামেন্ট হয়। বিষয়টি তেমন বিস্ময়কর নয়, কারণ আমাদের অনেকেই জানি না রাগবি বিশ্বকাপ কবে হচ্ছে কিংবা বাস্কেটবলের বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কোন দল? কোনো জরিপ কখনোই একটি বিষয়ের সম্পূর্ণটাকে বোঝাতে সক্ষম হয় না, তবে কিছুটা ধারণা দিতে পারে।

যে কোনো খেলার সাথে নিজেকে সমার্থক বানিয়ে ফেলার এই গুণটি অর্জন করা একটা বিশেষ কিছু। ফুটবলে এই গুণটি কার মাঝে আছে? ফুটবল সম্পর্কে জানেন না এমন মানুষও পেলের নাম অন্তত শুনেছেন। ফুটবলে শুধু একজনের নাম নিতে হলে পেলের নামই আসবে। পরিসংখ্যানগতভাবে হয়তো পেলেকে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব (যদিও সেটাও অনেক কঠিন কাজ), কিন্তু পেলের জায়গায় আরেকজনকে বসানো মনে হয় না সম্ভব।

পেলে নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন যে তাঁর অবসরের পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও পেলেকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন এমন খেলোয়াড় এসেছেন খুবই কম।কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ সেই জায়গায় যেতে পারেননি।

পেলে সর্বশেষ বিশ্বকাপ খেলেছেন ১৯৭০ সালে, এতদিন পরেও বিশেষজ্ঞদের যেকোনো তালিকায় প্রথম নামটা পেলেরই থাকে। দ্বিতীয় থেকে দশম ক্রমে অনেক নাম পরিবর্তন হয়। পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অনেক যুক্তিই দেখানো যাবে, কিন্তু এক নম্বরটা অপরিবর্তিতই রয়ে গিয়েছে।

বেশির ভাগ ফুটবল বিশেষজ্ঞের মতেই সবার চেয়ে অনেক খানি এগিয়ে থাকেন পেলে। ২০০০ সালে IFFHS (International Federation of Football History & Statistics) এর তত্ত্বাবধানে সাবেক খেলোয়াড় আর সাংবাদিকদের ভোটে শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করা হয়। তাতে ১৭০৫ ভোট পেয়ে পেলে প্রথম হন, দ্বিতীয় স্থানে থাকা ক্রুয়েফ পান ১৩০৩ ভোট।

`কালো মানিক’ খ্যাত ব্রাজিলের পেলেকে বলা হয় ফুটবলের সম্রাট। পেলে খেলেছেন এমন কোনো টুর্নামেন্টের সর্বকালের সেরা একাদশ থেকে মনে হয় তাকে বাদ দেয়া যাবে না। শুধু ফুটবলারই নন, জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়ী এক যোদ্ধার নাম পেলে।

ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরের এক বস্তিতে জন্ম পেলের, সঠিকভাবে বললে ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর। দরিদ্র পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবে অভাব অনটন মেটানোর জন্য ছেলেবেলাতেই পেলেকে চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়। এর সাথে রেলস্টেশনে ঝাড়ু দেবার পাশাপাশি কিছুদিন জুতা পরিষ্কার করার কাজও করেছিলেন। পেলের পুরো নাম ‘এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্তো’। নামটা রাখা হয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের নামের সাথে মিল রেখে।

ফুটবলে সহজাত প্রতিভা ছিল তার। ফুটবল কেনার টাকা ছিল না বিধায় মোজার ভেতরে কাগজ ঠেসে বানানো ফুটবলে চালাতেন অনুশীলন। ব্রাজিলের অন্যান্য খেলোয়াড়ের মতই গলির ফুটবলে পেলের প্রতিভা ফুটে ওঠে। কিন্তু উপরওয়ালার দয়াতেই হয়তো মাত্র ১৫ বছরের পেলের উপর নজর পড়ে সান্তোসের গ্রেট ওয়ালডেমার ডি ব্রিটোর। তা না হলে হয়তো তার প্রতিভা গলিতেই সীমাবদ্ধ থাকতো। ব্রিটো পেলেকে গলি থেকে নিয়ে যান সান্তোস ক্লাবে এবং সান্তোসের ‘বি’ টিমে তাকে সুযোগ দেন। এখানেও সহজাত প্রতিভা দেখিয়ে এক বছরের মাঝে সান্তোসের মূল দলে নিজের জায়গা করে নেন তিনি।

পেলে যখন সান্তোসের মূল দলে যোগ দেন, তখন তার বয়স ১৬ বছর। সেবার ব্রাজিলের পেশাদার ফুটবল লীগে সান্তোসের হয়ে লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটি অর্জন করেন তিনি। সেবারের ব্রাজিলিয়ান লীগে পেলের পারফরম্যান্স এতটাই নজরকাড়া ছিল যে, তা স্বয়ং ব্রাজিল সরকারেরও চোখ এড়ায়নি।

পেলের এই পারফর্মেন্স তাদের কাছে অমূল্য হিসেবে বিবেচিত হল। তাই আইন করে পেলেকে ব্রাজিলের জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল! রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার মত জায়ান্টরা তাকে দলে নিতে চাইলেও সরকারের অনুরোধে ইউরোপিয়ান লীগে পেলের কোনো দিন খেলা হয়নি।

পেলের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য ‘পেলে ল’ নামে একটি আইন ব্রাজিলে কার্যকর হয়েছে ২০০১ সালে ব্রাজিল ফুটবলে দুর্নীতির বিচারের জন্য!

অসাধারণ ব্যক্তি হিসেবেও পেলের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তখন ইউরোপে খেললে স্বাভাবিকভাবেই অনেক টাকা আয় করা যেত, কিন্তু সরকারের অনুরোধে দেশের স্বার্থে সেটা হাসিমুখে ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। পেলে ভুলে যাননি তার নিজের দারিদ্র্যে ভরা শৈশবকেও, ব্রাজিলের দরিদ্র শিশুদের সাহায্য করতে খেলোয়াড়ি জীবনেই গড়েছেন বিশেষ ফাউন্ডেশন। আর খেলা ছাড়ার পর কখনো ইউনিসেফের বিশেষ দূত, কখনও জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত, কখনও বা ব্রাজিলের ‘বিশেষ’ ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে সাধ্য মত চেষ্টা করেছেন তাদের সাহায্য করতে।

বৈশ্বিক কর্মকান্ডেও পেলের কিছু খ্যাতি আছে। একবার পেলে নাইজেরিয়ায় গিয়েছিলেন। সে সময় নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছিল। শুধুমাত্র পেলেকে দেখার জন্য নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিবদমান দলগুলো ৪৮ ঘণ্টার জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল!

রুপালী পর্দাতেও পেলেকে দেখা গিয়েছে। ১৯৬৯ সালে ব্রাজিলিয়ান টেলিভিশনের ধারাবাহিক ওস এস্ত্রানহোতে প্রথম দেখা গিয়েছিল কালো মানিককে। হলিউডের ছবি এসকেপ টু ভিক্টোরিতে মাইকেল কেইন, সিলভেস্টার স্ট্যালোনদের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এক যুদ্ধবন্দীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন পেলে। ১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বিংশ শতাব্দীর ১০০ জন মানুষের তালিকায় জায়গা পান পেলে।

এসব তো গেল খেলোয়াড় পেলের বাইরের কিছু কীর্তি, এবার খেলার ভেতরের কিছু কীর্তির কথা শোনা যাক।

ব্রাজিলের হয়ে পেলের আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। সময়টা ছিল ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই। সেই ম্যাচে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার কাছে ২-১ গোলের ব্যবধানে হেরে গেলেও প্রথম ম্যাচেই বিশ্বরেকর্ডটি করতে ভুল করেননি পেলে। ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে গোল করে তিনি অর্জন করেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড। পুরো ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ৯২টি হ্যাট্রিক, ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলদাতা (৭৭ গোল), ক্যারিয়ারে ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৮৩ গোল- এই পরিসংখ্যানগুলো তার অর্জনের খুব সামান্যটুকুই বোঝাতে পেরেছে।

পেলের যুগে ইউরোপিয়ান নন এমন খেলোয়াড়দেরকে ‘ব্যালন ডি অর’ সম্মাননা দেয়ার নিয়ম ছিল না। ২০১৬ সালে ব্যালন ডি অর এর ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯৫ সালের আগ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান নন এমন খেলোয়াড়দেরকেও বিবেচনায় এনে নতুন করে একটি তালিকা প্রকাশ করা হয় । এখানে পূর্ববর্তী ৩৯টি ব্যালন ডি অর-এ ১২টি পরিবর্তন হয়। ১৯৫৮, ১৯৫৯, ১৯৬০, ১৯৬১, ১৯৬৩, ১৯৬৪ আর ১৯৭০ এর ব্যালন ডি অর জয়ী ঘোষণা করা হয় পেলেকে। তবে সম্মানের জন্য আগের খেলোয়াড়দের নামও রাখা হয়।

তিনটি বিশ্বকাপ জেতা একমাত্র খেলোয়াড় পেলে, এই একটি কথাই তার অর্জনকে অনেক উপরে তুলে দেয়। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রতিটি বিশ্বকাপেই ফেভারিট হিসেবে যাত্রা করে ব্রাজিল। কিন্তু পেলে আসার আগে ২৮ বছর বিশ্বকাপ জিততে পারেনি তারা।

পেলে যাওয়ার পরেও পরবর্তী বিশ্বকাপ জেতে ২৪ বছর পরে। আপনি যখন জানবেন, চারটি বিশ্বকাপে ১৪টি ম্যাচ খেলে ১২টি গোল আর ১০টি অ্যাসিস্ট, দুটি ফাইনালে গোল করার রেকর্ড, চারটি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বকাপে গোল করার রেকর্ড- তাহলে পেলে সম্পর্কে আপনার শ্রদ্ধাবোধ আরেকটু বাড়ার কথা। বিশ্বকাপে পেলের অবদানগুলো এক নজরে দেখা যাক।

মাত্র ১৭ বছর বয়সে ব্রাজিলের মত দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলা যেন তেন বিষয় নয়। সেই বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্যায়ে একটি অ্যাসিস্ট দিয়ে শুরু করেন। কোয়ার্টারে ওয়েলসের বিরুদ্ধে পেলের একমাত্র গোলে ব্রাজিল সেমিফাইনালে পৌঁছে। এই গোল করে বিশ্বকাপে সর্বকনিষ্ঠ (১৭ বছর ২৩৯ দিন) গোলদাতা হিসেবে রেকর্ডবুকে নাম লেখান পেলে।

এরপর সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে বিশ্বকাপের সর্বকনিষ্ঠ (১৭ বছর ২৪৪ দিন) হ্যাটট্রিকদাতার রেকর্ড করেন। ফাইনালেও দুই গোল করেন । সেই বিশ্বকাপের সিলভার বল ও সিলভার বুট দুটোই জেতেন পেলে। এছাড়া সেই বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান তারকার পুরষ্কারও জেতেন তিনি।

১৭ বছর বয়সে বিশ্বকাপ জেতাটা কী, সেটা বোঝানোর জন্য আরও কিছু গ্রেটের পরিসংখ্যান উল্লেখ করা জরুরী মনে করছি।

ম্যারাডোনা ২২ বছর বয়সে প্রথম বিশ্বকাপ খেলেন। রোনালদো ১৮ বছর বয়সে বিশ্বকাপ একাদশে সুযোগ পান। কিন্তু রোমারিও, বেবেতোর ভিড়ে মূল একাদশে জায়গা পাননি। জিদান ফ্রান্সের মূল দলেই সুযোগ পান ২২ বছর বয়সে, আর বিশ্বকাপ একাদশে সুযোগ পান ২৬ বছর বয়সে। মেসি ১৯ বছর বয়সে বিশ্বকাপ একাদশে সুযোগ পান। কিন্তু সবগুলো ম্যাচে খেলার সুযোগ পাননি। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ২১ বছর বয়সে প্রথম বিশ্বকাপ খেলেন।

উপরে উল্লেখিত সব খেলোয়াড়ই কিংবদন্তি। তাদের কাউকে ছোট করার জন্য তথ্যগুলো দেয়া হয়নি। কিন্তু ১৭ বছর বয়সে তখনকার ব্রাজিল দলে সুযোগ পাওয়াটা যে একটা বিশেষ ব্যাপার, সেটা বোঝানোর জন্যই এর অবতারণা করা হয়েছে। আর পেলে সেই সুযোগটা কাজেও লাগিয়েছেন দারুণভাবে।

১৯৬২ এর বিশ্বকাপে পেলে তৎকালীন সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি নিয়ে খেলা শুরু করেন এবং আশা করা হচ্ছিল এটা পেলের টুর্নামেন্ট হবে। চিলির বিরুদ্ধে প্রথম গোলে অ্যাসিস্ট করে আর চারজন ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করে দ্বিতীয় গোল দিয়ে সেই পথেই ছিলেন তিনি। কিন্তু চেকোস্লোভিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে ইনজুরিতে পড়ে বাকি টুর্নামেন্ট মিস করেন।

তারপরে ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপের ব্রাজিলের দলকে ধরা হয় তৎকালীন ব্রাজিলের সেরা দল। গ্যারিঞ্চা, গিলমার, সান্তোস, জোয়ারজিনহো, টোস্টাও, গারসেন, আর সাথে পেলে। কিন্তু সবাইকে হতাশ করে মাত্র তিনটি ম্যাচ খেলে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় ব্রাজিল।

প্রথম ম্যাচে বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে পেলে গোল করেন, কিন্তু বুলগেরিয়ান ডিফেন্ডারদের বর্বরোচিত ফাউলে ইনজুরিতে পড়ে পরের ম্যাচ মিস করেন। হাঙ্গেরীর বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে হেরে যায় ব্রাজিল। কোচ ভিসেন্তে ফিওলা গ্রুপের শেষ খেলায় ইউসেবিওর পর্তুগালের বিপক্ষে যখন পেলেকে নামান, তখন সবাই আশ্চর্যান্বিত হয়ে যায়। কারণ তখনও পেলে তার ইনজুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

সেই ম্যাচটাকে ‘৬৬ এর বিশ্বকাপের সবচেয়ে বাজে ম্যাচ বলে স্বীকার করা হয়। ওই ম্যাচে পুরো ব্রাজিল দল, বিশেষত পেলেকে এত বেশি পরিমাণ ফাউল করা হয় যে, পেলে মাঠ থেকে তো ইনজুরড হয়েই বের হন, সেই সাথে ম্যাচের পর তিনি অবসরের ঘোষণাও দেন। পরবর্তীতে ইউসেবিও এবং পর্তুগালের সমস্ত টিম মেম্বার অফিসিয়ালি ব্রাজিলের কাছে ক্ষমা চায়।

এরপর ১৯৭০ এর বিশ্বকাপে পেলের খেলার কথা ছিল না। কিন্তু ১৯৬৯ এর শুরুতে পেলেকে আবার দলে নেয়া হয় এবং বাছাই পর্বে তিনি ৬ ম্যাচে অংশ নিয়ে ৬টি গোল করেন। এই টুর্নামেন্টে পেলে মূলত প্লে-মেকার হিসেবে খেলেন। ফাইনাল ম্যাচে ইতালির বিরুদ্ধে প্রথম গোলটি সহ পুরো টুর্নামেন্টে ৪টি গোল আর ৭টি অ্যাসিস্ট করে সেই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতে নেন তিনি।

সাথে বিশ্বকাপ জিতে জুলেরিমে কাপটাকে চিরতরে নিজেদের করে নেন। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন, ফুটবলে প্রজন্ম একটা বড় বিষয়। এক প্রজন্ম সচরাচর দুটি বিশ্বকাপ ভাল খেলে। কিন্তু পেলে চারটি বিশ্বকাপেই তার যাদু দেখিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা- বিভিন্ন প্রজন্মের সাথে সুন্দরভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। প্রতিটি বিশ্বকাপের শেষে একটি অলষ্টার দল ঘোষণা করা হয়। পেলে ১২ বছরের ব্যবধানে দুটি দলে (১৮৫৮ ও ১৯৭০) জায়গা পান। এত সময়ের ব্যবধানে এরকম কোনো দলে আর কোনো খেলোয়াড় সুযোগ পাননি।

জাতীয় দলের পাশাপাশি ক্লাব ফুটবলেও পেলে অসাধারণ ছিলেন। দলগতভাবে ক্লাবের হয়ে শিরোপা জিতেছেন ২৬টি। ঘরোয়া লীগে ১১ বার সর্বোচ্চ স্কোরার হওয়ার কৃতিত্ব তার অর্জনের সামান্যটুকুই বোঝাতে সক্ষম।

পেলের সম্পর্কে অনেকের একটা অভিযোগ আছে যে, তিনি ইউরোপীয় ফুটবলে কখনও খেলেননি, যা কিনা তার জন্য একটা সীমাবদ্ধতা। তিনি ইউরোপে খেলেন নি, কিন্তু ইউরোপে তার পারফর্মেন্স বিস্ময় জাগানোর জন্য যথেষ্ট। জাতীয় দল ছাড়াও ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে তো তার পারফর্মেন্স মুগ্ধ করার মত। তবে এগুলো ছাড়াও পেলের আরও কিছু ম্যাচ আছে ইউরোপিয়ান দলগুলোর বিপক্ষে। এসব দলের বিপক্ষে ১৩০ ম্যাচ খেলে পেলের গোল ১৪২ টি।

ক্লাবের হয়ে দুটি মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্টে পেলের কিছু অবদান তুলে ধরা যাক। ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ একসময় হত শুধুমাত্র ইউরোপ জয়ী আর ল্যাটিন জয়ীদের মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করার জন্য। পরবর্তীতে এটি ক্লাব ফুটবল নামে পরিচিত লাভ করে এবং এই টুর্নামেন্টে আরও কয়েকটি মহাদেশের চ্যাম্পিয়নরা অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। এই টুর্নামেন্টের মূল উদ্দেশ্য থাকে বছরের শ্রেষ্ঠ ক্লাব নির্বাচন করা।

সান্তোস এই টুর্নামেন্টটি জিতেছে দু’বার, দু’বারই পেলে থাকার সময়। শুধুমাত্র এই তথ্যটুকু পেলের গুরুত্ব পুরোপুরি বোঝাতে পারছে না। পুরোটা বুঝতে চাইলে একটু জানতে হবে।

১৯৬২ সালে সান্তোসের প্রতিপক্ষ ছিল সেই সময়ের আরেক গ্রেট ইউসেবিওর বেনফিকা। চ্যাম্পিয়ন্স লীগ শুরু হওয়ার পর সেটিতে একটানা পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লীগকে নিজের সম্পদ বানিয়ে ফেলা রিয়াল মাদ্রিদ ছিল ইউরোপের জায়ান্ট।

ফাইনালে সেই জায়ান্ট বধ করে বেনফিকা ইউরোপের সর্বোচ্চ সাফল্য পায়। যদিও এর আগের বছরেই বেনফিকা ইউরোপে চ্যাম্পিয়ন হয়, কিন্তু রিয়ালের মুখোমুখি হতে হয়নি। ১৯৬২ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে রিয়াল ছিল দুই কিংবদন্তি স্টেফানো আর পুসকাস সহ। ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়েও সেই ম্যাচ ৫-৩ গোলে জিতে নেয় বেনফিকা। পুসকাসের হ্যাটট্রিকের জবাব দেন ইউসেবিও দুই গোল করে। যা-ই হোক, সে গল্প না হয় আরেকদিন শোনা যাবে।

প্রথম লেগে ঘরের মাঠে সান্তোস মুখোমুখি হয় বেনফিকার। পেলের দুই গোলে ম্যাচটা জিতলেও (৩-২) দুইটি মূল্যবান অ্যাওয়ে গোল পেয়ে যায় বেনফিকা। নিজের মাঠে ১-০ গোলে জিতলেই চ্যাম্পিয়ন হত বেনফিকা। কিন্তু পেলে হয়তো ভিন্নভাবে ভেবেছিলেন। ৫-২ গোলে জেতা ম্যাচটিতে হ্যাটট্রিক করে সান্তোসকে প্রথম ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জেতান তিনি।

১৯৬৩ সালে সান্তোসের প্রতিপক্ষ ছিল বেনফিকাকে হারিয়ে আসা এসি মিলান। এসি মিলানের মাঠে গিয়ে ৪-২ গোলে ম্যাচ হারলেও মূল্যবান ২টি অ্যাওয়ে গোল করেন পেলে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় লেগে সান্তোস ম্যাচ জিতলেও দুই লেগ মিলিয়ে খেলা ড্র হয়। প্লে অফে সান্তোস টুর্নামেন্ট জেতে।

ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের ইতিহাসে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে হ্যাটট্রিক করার রেকর্ড পেলের। তবে নাম পরিবর্তন করে ক্লাব বিশ্বকাপ হওয়ার পর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ২০১৬ সালে হ্যাটট্রিক করেছেন।

আমাদের অনেকের জানার ইচ্ছা যে, পেলে কোন পজিশিনে খেলতেন? বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কিংবা কোচদের সর্বকালের একাদশে তাকে মূলত স্ট্রাইকার হিসেবেই রাখা হয়। তবে পেলে দুর্দান্ত একজন প্লে-মেকারও ছিলেন।

তবে সবচেয়ে মজার উত্তর দিয়েছিলেন কোচ সালদানা। তিনি ১৯৬৯-১৯৭০ সালে ব্রাজিলের জাতীয় দলের কোচ ছিলেন। ব্রাজিলের একজন সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন- তার স্কোয়াডের সবচেয়ে সেরা গোলকিপার কে? উত্তরে তিনি পেলের নাম নিয়েছিলেন। তার মতে, পেলে যে কোনো পজিশনেই খেলতে পারতেন।

শেষ করার আগে পেলে সম্পর্কে বিখ্যাত কয়েকজন খেলোয়াড়ের উক্তি তুলে ধরতে চাই। পশ্চিম জার্মানির গ্রেট বেকেনবাওয়ারের পেলেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘পেলে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়। তিনি ২০ বছর সবার চেয়ে এগিয়ে থেকে ফুটবল বিশ্বে রাজত্ব করেছেন। দিয়েগো ম্যারাডোনা, ক্রুয়েফ, প্লাতিনির মত খেলোয়াড়েরাও তার পেছনে থাকবে। পেলের সাথে তুলনা করার মতও কেউ নেই।’

ক্রুয়েফের মতে, ‘পেলে হচ্ছেন একমাত্র খেলোয়াড় যিনি যুক্তির সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।’

তবে পেলে সম্পর্কে সবচেয়ে মুগ্ধকর কথা বলেছেন হাঙ্গেরিয়ান লিজেন্ড ফেরেঙ্ক পুসকাস। তিনি বলেন, ‘সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হচ্ছেন আলফ্রেডো ডি স্টেফেনো। আমি পেলেকে এই তালিকার বাইরে রাখছি। কারণ তিনি এসবের উর্ধ্বে।’

লেখক পরিচিতি

Alien.............

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link