প্রথমে অভিনয়, এরপর কি বুঝে যেন সখ্যতা আয়তাকার সবুজের সাথে। সাত বছর বয়স থেকে শুরু তাঁর পর থেকে যেন কোন বাঁধাই আর দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি পিটার চেক আর ফুটবলকে। কতশত রোমাঞ্চকর ম্যাচের নায়ক তিনি তাঁর তো হিসেব নেই। অথচ দৃশ্যপট হতে পারত ভিন্ন। তিনি হয়ে যেতে পারতেন একজন অভিনেতা। তখন হয়ত তাঁর জীবনে খুব বেশি ট্র্যাজেডি এসে হানা দিত না নিশ্চয়ই।
২০ মে ১৯৮২ সালে চেক প্রজাতন্ত্রে জন্ম ইংলিশ ক্লাব চেলসির কিংবদন্তি গোলরক্ষক পিটার চেকের। দীর্ঘ প্রায় ১১টি বছরের বন্ধুত্ব, ভালবাসা লন্ডনের সেই ক্লাবের নীল জার্সিটার সাথে। তিনি যেন ছিলেন চেলসির জালের অতন্দ্র প্রহরী। তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্যে চেলসির জয়ের গল্প তো আর কম লেখা হয়নি। খেলোয়াড়ি ডিএনএ নিজের মধ্যেই ধারণ করা চেক, তাঁর দেশের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজন সেটা নিয়েও সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
পিটার চেকের বাবা-মা দুইজনই ছিলেন অ্যাথলেট। সবচেয়ে মজার বিষয় চেক জন্মেছিলেন আরও দুই ভাই-বোনের সাথে। অর্থাৎ তাঁরা ছিলেন তিনজন জমজ। যদিও একসাথে জন্ম নেওয়ার তাঁর ভাই মাইকেল দুই বছর বয়সে সংক্রমণে মারা যান। তবে কোন ধরণের সমস্যা ছাড়াই বেঁচে ছিলেন চেক। তবে সমস্যার শুরু তো হয় তারও বেশকিছু বছর পর। সমস্যা না ঠিক, তাঁর দুর্ভাগ্য।
পিটার চেক ১৯৯১ সালের দিকে ‘দ্য টেরিটরি অব হোয়াইট ডিয়ার’ নামক একটা ধারাবাহিকে অভিনয় করেছিলেন। তবে বাবা-মায়ের থেকে প্রাপ্ত খেলোয়াড়ি ডিএনএ তাঁকে টেনে নিয়ে আসে ফুটবল মাঠে। মাত্র সাত বছর বয়স থেকেই তিনি ভিক্টোরিয়া প্লাজেন নামক এক স্থানীয় ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলতে শুরু করেন। এখানেও একটা তথ্যে খানিকটা বিস্ময় জাগানিয়া। ফুটবল জীবনের প্রথম দিকে তিনি ছিলেন একজন স্ট্রাইকার।
হ্যাঁ, আমরা যাকে গোলবারের নিচে তুখোড় সব স্ট্রাইকারদের শট ফিরিয়ে দিতে দেখেছি তিনি তাঁর খেলোয়াড়ি জীবন শুরু করেছিলেন একজন স্ট্রাইকার হিসেবে। তবে ওই যে ভাগ্যের নির্মমতা। ফুটবল খেলতে গিয়েই পা ভেঙে ফেলেন তিনি। দশ বছরের সে ঘটনার পর তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন তিন কাঠির নিচে। তিনি মূলত গিয়েছিলেন নিজে পা ঠিক হবার সময় দিতে।
তবে তিনিও হয়ত ভাবতে পারেননি যে সে তিন কাঠির নিচে দস্তানা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এবং প্রতিপক্ষের বিদ্যুৎ গতির শট ঠেকিয়ে দেওয়া হয়ে যাবে তাঁর প্রথম প্রেম। গোলরক্ষক হওয়াও যে একটা শিল্প আর সে শিল্পের প্রেমে পড়ে যাবেন চেক সেটা হয়ত কিশোর বয়সে কল্পনাও করেননি। কিন্তু পরিণত হয়ে তিনি আরও যেন ছাড়িয়ে গেছেন নিজের কল্পনাকে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এক সময় সেরা গোলরক্ষক হিসেবেই বিবেচিত হতেন তিনি।
নিজ থেকে ফ্রান্স সেখান থেকে ইংল্যান্ডে ঠাঁই। দেশ ও ক্লাবের হয়ে দুর্দান্ত খেলতে থাকা পিটার চেক ইংলিশ পরাশক্তিদের নজরে আসবেন না তা কি করে হয়। আর্সেনাল ও চেলসির রাডারে ছিলেন তিনি। আর্সেনাল বেশ তোড়জোড় করেছিল তবে নানা জটিলতায় তাঁকে দলে ভেড়াতে পারেনি গানার্সরা। তবে সুযোগের সদ্ব্যবহারটা ঠিকঠাক মত করে ফেলে চেলসি। টুক করে সকল জটিলতার অবসান ঘটিয়ে তাঁকে নিয়ে আসে স্ট্যাম্পফোর্ড ব্রিজে।
সেখান থেকেই খেলোয়াড়ি জীবনের উত্থান। আর অন্যদিকে, ব্যক্তিগত জীবনে চুটিয়ে চলে প্রেম। স্কুল জীবনের বান্ধবী মার্টিনার সাথে সম্পর্কটা এতটাই সুমধুর ছিল যে চেক একবার বলেছিলেন যে মার্টিনাকে ছাড়া হয়ত তিনি জীবনটা ভালভাবে উপভোগই করতে পারতেন না। একদিকে চেলসিতে থিতু হয়েছেন অন্যদিকে দীর্ঘদিনের বান্ধবীকে বিয়ে করে ফেলেছেন। দিন ভালই যাচ্ছিল চেকের।
তবে মানুষের জীবন কখনোই হয়ত এক ধারায় চলতে পারে না। চেকের ক্ষেত্রেও সে ভিন্নতা ছিল না। ২০০৬ সালের শেষ ভাগে। অক্টোবরের ১৪ তারিখ। এই দিনটি নিশ্চয়ই ভুলে যেতে পারবেন না চেক কিংবা মার্টিনা অথবা ফুটবল সমর্থকেরা। এই দিনটি নিশ্চয়ই চেকের জীবনের সবচেয়ে বাজে দিন। ভাগ্যের জোরে সেদিন হয়ত বেঁচে গিয়েছিলেন। প্রিমিয়ার লিগের এক ম্যাচে সেদিন রিডিংয়ের মিডফিল্ডার স্টিফেন হান্টের সাথে বাজে ভাবে সংঘর্ষ হয় চেকের।
মুহূর্তে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় তাঁকে মাঠের ভেতরেই। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে অস্ত্রপচারও করা হয় তাঁর। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে, অল্পের জন্য সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান পিটার চেক। সে ম্যাচ বদলি নামা আরেক গোলকিপার কার্লো কুডিসিনিও ইনজুরি কারণে মাঠ ছাড়েন। বাধ্য হয়ে বাকি থাকা ম্যাচে চেলসির অধিনায়ক জন টেরি গোলরক্ষকের দস্তানা হাতে দাঁড়িয়ে পড়েন।
সে ইনজুরি থেকে ফিরে উঠতে পিটার চেককে মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে প্রায় তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে। এরপর তিনি আবার মাঠে ফিরেছেন। জীবন হারাবার ভয়কে জয় করে তিনি ফিরেছেন কাল রঙের এক হেলমেট মাথায় নিয়ে। সে হেলমেট পড়েই তিনি ২০১৯ সাল অবধি খেলে গেছেন ফুটবল। চেলসির পর আরও এক ইংলিশ ক্লাব আর্সেনালের হয়েও তিনি গোলরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এর পর ফুটবল মাঠ ছেড়ে গেলেও পিটার চেক ছাড়তে পারছেন না নিজের ভেতর থাকা খেলোয়াড়ি ডিএনএকে। তাইতো ক্লাব পর্যায়ে প্রায় ৫৬৭ ম্যাচ ও জাতীয় দলের হয়ে ১২৪ ম্যাচে গোলবারের দায়িত্ব পালন করা চেক নিজেকে ঠেলে দিয়েছেন নতুন এক চ্যালেঞ্জের সামনে। তিনি এখন একজন পেশাদার আইস হকি খেলোয়াড়। খেলছেন ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বিভাগ আইস হকি লিগে। পরিবার আর আইস হকি নিয়েই কাটছে পিটার চেকের বর্তমান সময়।