বিবর্তনবাদের বৈপ্লবিক বীর

আক্ষরিক অর্থেই ক্রিকেট একটা পুরনো খেলা। আন্তর্জাতিক ময়দানে খেলাটির বয়স প্রায় দেড়শ ছুতে চললো। এই লম্বা সময়ে ক্রিকেটের গুণগত মান ও ধরণে অনেক পরিবর্তন যে এসেছে – সেটা বলাই বাহুল্য।

প্রথম একশ বছর এই খেলাটা কেবলই বড় পরিসরেই খেলা হত। মানে কেবল টেস্ট আর প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। ৭০-এর দশকের গোড়ায় আসল ওয়ানডে ক্রিকেটের। শুরুতে আয়তনে কমলেও খেলার ধরণে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। পাওয়ার হিটার কিংবা স্লগার বলতে তেমন কোনো শব্দই ছিল না। ফিল্ডাররাও ছিলেন না আজকের মত উদ্যমী।

কিন্তু, পরিবর্তনই তো পৃথিবীর নিয়ম, নিয়তি। ক্রিকেটই বা কেন বাদ থাকবে। বিয়ন বর্গ যেভাবে দুই হাতের ব্যাকহ্যান্ডের প্রচলন করেছিলেন টেনিসে, তেমনি ক্রিকেটেও এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। আর টি-টোয়েন্টির এই যুগে এসে যেন রোজই আসছে নানারকম ইতিবাচক ও নেতিবাচক পরিবর্তন।

আর ক্রিকেটের এই বিবর্তনে পেছনের মানুষগুলোর সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। এবার তাঁদেরই স্মৃতিচারণা করা যাক।

  • ব্যাটিং

ক্রিকেটে বড় পরিবর্তন এসেছে অবশ্যই ব্যাটিংয়ের মানসিকতায়। আগে যেমন টেস্ট আর ওয়ানডে ব্যাটিংয়ে বড় কোনো পার্থক্য ছিল না। গ্যারি সোবার্সের মত দুই একজন বাদে কেউই বোলারদের মেরুদণ্ডে শীতল স্রোত প্রবাহিত করতে পারতেন না, সেই চাহিদাও ছিল না।

তবে, এরপর এলেন এক ক্যারিবিয়ান। কোনো হেলমেট ছাড়াই মুখে চুইংগাম চিবুতে চিবুতে বাইশ গজে এসে প্রমাণ করলেন, বলটাকে স্রেফ পেটাতেই হবে। তিনি স্যার ভিভ রিচার্ডস। আধুনিক ক্রিকেটের তিনি অন্যতম সেরা কিংবদন্তি। একই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার ডিন জোন্স অথবা ভারতের কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্তও ভয়ডরহীন ব্যাটিং করতেন। তবে, ভিভ ছিলেন অবিসংবাদিত সেরা।

পরবর্তীতে শচীন টেন্ডুলকার, বীরেন্দ্র শেবাগ, অ্যাডাম গিলক্রিস্টরা বা এবি ডি ভিলিয়ার্সরাও ওই একই ধারার লোক। আর ক্রিস গেইল এসে বলে দিলেন, বলটাকে কেবল পেটানোই নয় – বাউন্ডারি কিংবা ওভার বাউন্ডারিই হাঁকাতে হবে। দৌঁড়ানো কেবল সময় নষ্ট করার অপর নাম।

  • বোলিং

৭০ বা ৮০’র দশকে বিশ্বে প্রচুর কোয়ালিটি ফাস্ট বোলার ছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস চতুষ্টয়ের সাথে যোগ হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার জেফ থমসন ও ডেনিস লিলি। পাকিস্তানে ছিলেন ইমরান খান কিংবা সরফরাজ নওয়াজ, ভারতে ছিলেন কপিল দেব। ওই সময়টায় বিশ্বের ফাস্ট বোলিং চূড়ান্তরুপে পাল্টে যায়।

কি ছিল না তাদের! গতি, মুভমেন্ট – সব! কেবল জেফই নাকি ১৮০ কিলোমিটার গতিতে বল করতে জানতেন। আর ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিংরা ব্যাটসম্যানদের নরক যন্ত্রনা দিতে জানতেন। সরফরাজ নওয়াজদের হাত ধরে পৃথিবি দেখে আরেক বিপ্লব – রিভার্স স্যুইং।

নব্বইয়ের দশকে দেখা যায় আরেক বিপ্লব। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুসের জুটি আলোড়ন তোলে। পাকিস্তানের অস্ত্রশালায় পরে যোগ হন শোয়োব আখতার। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার ছিল গ্লেন ম্যাকগ্রা ও ব্রেট লি। ওয়েস্ট ইন্ডিজে ছিল কোর্টনি ওয়ালশ ও কার্টলি অ্যামব্রোস। ব্রেট লি নাকি শোয়েব – কে বেশি গতিতে বল করেন – সে নিয়ে ওই সময় আলোচনা হত বিস্তর।

এবার আসা যাক স্পিন বোলিংয়ের প্রসঙ্গে। একটা সময় স্পিনারদের দলের অলঙ্কার বাদে বেশি কিছু ভাবতো না দলগুলো। হ্যাঁ, গ্যারি সোবার্স কিংবা হেডলি ভেরিটির মত কিছু কিংবদন্তিরা নিজেদের কর্মগুণেই ছিলেন কিন্তু, অধিকাংশ দলই স্পিনার রাখতো না বললেই চলে। এর আগে অবশ্য আলফ ভ্যালেন্টাইন বা সনি রামদিনের জুটি দেখেছিল ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট।

এরপর আসলে ভারতের স্পিন চতুষ্টয়। দেশের মাটিতো বটেই – বিদেশেও ভারত একই ম্যাচে একাধিক স্পিনার খেলাতে লাগলো। এরপর স্পিন বোলিংয়ের চূড়ান্ত বিকাশ হয় ভারত-পাকিস্তানে। পাকিস্তানে আব্দুল কাদির, মুশতাক আহমেদের পর আসেন সাকলাইন মুশতাক। ওদিকে ভারতে ছিলেন অনিল কুম্বলে আর হরভজন সিং।

নব্বইয়ে এসে লেগস্পিন পায় শিল্পের মর্যাদা। আবার অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্ন আর শ্রীলঙ্কার মুত্তিয়া মুরালিধরণের লড়াইটা বেশ জমে ওঠে। দু’জনের মধ্যে সর্বকালের সেরা স্পিনার কে? – সে নিয়েআজো আলোচনা হয় বিস্তর।

আর এখনকার ক্রিকেটে স্পিনার ছাড়া চলেই না। বিশেষ করে ফিঙ্গার স্পিনার, রহস্য স্পিনার টার্মগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও আজকাল তাঁরা হটকেক।

  • ফিল্ডিং

এমন না যে, তাঁর আগে কোনো ভাল ফিল্ডারের জন্ম হয়নি কোথাও, তবে এটা ঠিক যে – জন্টি রোডসের মত নিখুঁত তাঁদের আর কেউউ ছিলেন না। তিনি অবশ্যই ফিল্ডিংয়ের সুপারম্যান। তাঁর ফিল্ডিং সামর্থ্যের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। ইনজামাম উল হকের বিখ্যাত সেই রান আউট আজো যেন চোখে ভাসে ক্রিকেট পিপাসুদের।

পরবর্তীকালে আরো বিখ্যাত কিছু ফিল্ডারের দেখা মিলেছে। মোহাম্মদ কাইফ, যুবরাজ সিং কিংবা ফাফ ডু প্লেসিস, এবি ডি ভিলিয়ার্সরা এসেছেন। তবে, কেউই জন্টি রোডসে ছুতে পারেননি। তবে, একটা ব্যাপার ঠিক যে – এখন ফিল্ডিংটা পারতেই হবে সবাইকে।

  • উইকেটরক্ষণ

খুব বেশি আগের কথা নয়, আশির দশকেও উইকেটরক্ষকের কাজ শুধু উইকেটের পেছনে দাঁড়ানোই ছিল। শেষের দিকে নেমে তিনি পারলে কিছু রান করবেন, না করলেও দোষের কিছু নেই – এই ছিল রীতি। তবে, সেই রীতিটা বেমালুম পাল্টে গেল নব্বই দশকে।

রমেশ কালুভিতারানা, নয়ন মঙ্গিয়া বা মঈন খানরা ব্যাটিং জানতেন। তবে, এর বিপ্লবটা আসে আরো পরে। সেই বিপ্লবের শীর্ষে ছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, কুমার সাঙ্গাকারা ও মহেন্দ্র সিং ধোনি। তাঁরা কেবল উইকেটের পেছনেই সফল নন, উইকেটের সামনে ব্যাট হাতেও সর্বকালের সেরাদের কাতারে।

এমনকি পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যানদের একটু শিখিয়ে পড়িয়ে উইকেটের পেছনে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার নজীরও দেখা গেছে নব্বইয়ের দশকে। রাহুল দ্রাবিড় বা এবি ডি ভিলিয়ার্স এই কাজ করেছেন।

আর এখনকার সময় উইকেরক্ষকদের ব্যাটিং জানাটা বাধ্যতামূলক। উইকেটরক্ষণে একটু কাঁচা হলেও ব্যাটিংটা ভাল বলে টিকে যান অনেকেই। এর ফলে যেটা হয়েছে নিখুঁত অলরাউন্ডারদের আজকাল আর খুব একটা দেখা যায় না। ঋদ্ধিমান সাহারা এখানে এখন কেবলই বিরল এক প্রজাতি।

  • অলরাউন্ডার

অলরাউন্ডার ক্রিকেটে আগেও ছিল। সেই ডব্লিউ জি গ্রেসের জমানা থেকেই শুরু এই ধারণা। তাঁকেই চাইলে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার বলা যায় কোনো সন্দেহ ছাড়াই।

তবে, এই ধারণার পূর্ণতা আসে ৭০-৮০’র দশকে। তখন চারজন অলরাউন্ডার চারটি দেশ থেকে বিশ্ব কাঁপাতেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ভারতের কপিল দেব, পাকিস্তানের ইমরান খান, ইংল্যান্ডের ইয়ান বোথাম ও নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হ্যাডলি।

চারজনই ছিলেন পেস বোলিং অলর‌াউন্ডার। ব্যাটিং আর বোলিং দু’টোই পাল্লা দিয়ে করতেন তাঁরা। এর আগে ছিলেন স্যার গ্যারি সোবার্স – তিনি অবশ্য স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার ছিলেন।

নব্বইয়ের দশকে অবশ্য ওই চার-পাঁচজনের মানের অলরাউন্ডার ছিলেন না। তবে, ল্যান্স ক্লুজনার, ক্রিস কেয়ার্নস, হিথ স্ট্রিক, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি কিংবা ওয়াসিম আকরাম জ্বলে উঠতেন কখনও কখনও। তবে, পরে এদের সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক ক্যালিস।

আর এখনকার ক্রিকেটে দুনিয়ায় শুধু অলরাউন্ডারদেরই রাজত্ব। জেসন হোল্ডার, মার্কাস স্টোয়িনিস, সাকিব আল হাসান, রবীন্দ্র জাদেজা, মোহাম্মদ নবী, হার্দিক পান্ডিয়া, মঈন আলী, বেন স্টোকস, আন্দ্রে রাসেল কিংবা কাইরেন পোলার্ডরা – আন্তর্জাতিক কিংবা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে সমান জনপ্রিয়।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link