উদাস কবির কাব্য

তারকাখচিত পৃথিবীর মাঝে অলস কবির পদ্য লেখার জন্য আলাদা হয়ে যাওয়া খুব জরুরি। ঝলমলে আলোর শোভা তাদের উপযোগী নয়, কোনও ফ্ল্যাশলাইটের চমকও তাদের উপঢৌকন হতে পারে না। ডেনিশ বার্গক্যাম্প সেই উদাসী পথের পথিক। স্বর্ণযুগের ডাচ টিমে হাতেখড়ি হওয়া এক আজাদ কবি।

নি:শব্দে খেলে গিয়েছেন, নি:শব্দেই প্রস্থান করেছেন। সমসাময়িক রোনালদো-জিদান-ফিগো বা পরের মেসি-রোনালদোকে নিয়ে যে আলোচনা, লেখালিখির কার্যত ঝড় বয়ে যায় নিরন্তর, বার্গক্যাম্প সে সব কিছুই পাননি। শায়র শায়রি লেখেন কিছু পাওয়ার জন্য নয়।

‘হাজারও খোয়াইশে অ্যায়সে, কে হার খোয়াইশ পে গম নিকলি’!

এমন একটা সময় ছিল যখন ডাচ টিমের স্বর্ণযুগ রচিত হয়েও ট্রফি জেতার একটু আগেই সোনার দৌড় থেমে গেছে। প্যাট্রিক ক্লুইভার্ট, মার্স ওভারমার্স, বার্গক্যাম্প, ব্রঙ্কহর্স্টরা সে সোনালী ডাচ টিমের স্তম্ভ। এহ বাহ্য – বার্গক্যাম্প টিমটার মোস্ট কমপ্লিট স্ট্রাইকার। কিছু অসাধারণ গোলের জন্য শুধু তাকে মনে রাখাটা বার্গক্যাম্প ডিজার্ভ করেন না।

আসলে বার্গক্যাম্প অনেক কিছুই ডিজার্ভ করেন না। অনেক হেরে যাওয়া, অনেক কিছু না পাওয়ার ইতিহাস যেমন প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত করে লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনাকে, তেমনই হল্যাণ্ডের ফুটবল ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে অসংখ্য বুকফাটা আর্তনাদের গল্প। যা শুরুই হয়েছিল টোটাল ফুটবলের প্রাণপুরুষ ইয়োহান ক্রুয়েফকে দিয়ে। একটা ইউরো কাপ জয় মুছে দিতে পারেনি ডাচদের শূন্য বুকের ক্ষত। তারই প্রতিনিধি ডেনিস বার্গক্যাম্প।

অথচ বার্গক্যাম্প কিছু পেতে আসেনওনি। বাস্তেন, রাইকার্ড, রোনাল্ড কোম্যানদের ভরা কনসর্টের মাঝে বার্গক্যাম্প ছিলেন হঠাৎ বেজে ওঠা পিয়ানোর টুংটাং। মাঠে তার অবাধ বিচরণ। অথচ সারা মাঠে তাঁকে সেভাবে দেখা যায় না। গোলের আশেপাশে বল ঘুরলে হঠাৎই শৈল্পিক ছোঁয়ায় বল গোলে ঢুকে যায়। বার্গক্যাম্প ছিলেন এইরকম, ভীষণ আনমনা অথচ সুপারস্টার।

বার্গক্যাম্পের জন্মদিনে মেসি-রোনালদোর মতো ট্রিবিউট লেখা আসে না, নিউক্যাসল ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গোলের পরেও কোনও আলোচনার টেবিলে তুফান ওঠে না। আসলে শায়রি সকলের জন্য নহে। কিছু কিছু মূহূর্ত আসে একাকিত্ব উপভোগের কারণেই। বার্গক্যাম্প সেই একাকীত্বে পায়ের আলতো ছোঁয়ায় জীবনমুখী গান শুনিয়ে যান। আর্সেন ওয়েঙ্গার রত্ন চিনেছিলেন।

শেষ বয়সের ডুবন্ত সূর্য যখন, তখনও আর্সেনালের দশ নম্বর ডান পায়ের ইনস্টেপে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে গোল করছেন, এমিরেটসে রেখে যাচ্ছেন সায়াহ্নের পদচিহ্ন। থিয়রি অঁরি কায়মনোবাক্যে স্বীকার করেছেন – জীবনের একমাত্র স্বপ্ন বার্গক্যাম্পের মতো স্ট্রাইকার হওয়া।

বিশেষজ্ঞদের মতে দ্য মোস্ট কমপ্লিট ফুটবলার – বার্গক্যাম্প মাঠের প্রতিটি ঘাসে ফেলে রেখে গিয়েছেন কবিতার ছোঁয়া, এমিরেটসের ড্রেসিংরুমে লিখে এসেছেন শায়রি। দেওয়ালে লিখে রাখা কবিতারা একসময় মুছে গেলেও ছাপ রেখে যায়। বার্গক্যাম্প সেই রেখে যাওয়া দাগের অংশীদার।

বার্গক্যাম্প কখনও ট্রফি হাতে ভিকট্রি ল্যাপ দিতে পারেননি, অবশ্য আনমনা কবিদের ওগুলো ঠিক শোভা পায় না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link