তিল তিল করে যে সুন্দর হয়, সেই তো তিলোত্তমা

মোহাম্মদ আশরাফুল অস্ট্রেলিয়া কিংবা শ্রীলঙ্কার মত দলের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করবার পর ঘাসের উপর নতজানু অবস্থায় চুম্বন করতেন। হাবিবুল বাশার সুমনের বাংলাদেশ তখন উদীয়মান এক ক্রিকেট দল

আশরাফুল, আব্দুর রাজ্জাক, অলক কাপালি, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মোহাম্মদ রফিকেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে যেতেন তখন। আমার প্রিয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশ কখনই নয়, তবুও ওদের খেলা দেখে যেতাম কারণ ইএসপিএনের চ্যানেলগুলোতে একটু বাংলার ছোঁয়া পাবো বলে।

আশরাফুলের সেঞ্চুরি তখন সবুজ স্বপ্নওয়ালাদের কলজে, বাঁহাতি স্পিনে সৌরভ গাঙ্গুলি বা রিকি পন্টিং আউট হবার পর এক আশ্চর্য্য রকমভাবে লাফিয়ে উঠতেন মোহাম্মদ রফিক, এক সাথে লাফিয়ে উঠত বাংলাদেশও, কখনও চট্টগ্রামে, কখনও ঢাকায়, কখনও কার্ডিফে।

স্টাম্প মাইক তখনও অতোটা কার্যকরী ছিলোনা। তথাপি মাইকের পিছন থেকে উইকেটরক্ষক খালিদ মাসুদের আওয়াজ ভেসে আসতো ‘ভালো বল, ভালো বল’। এই এটুকুর জন্যেই তো বাংলাদেশকে দেখা। এতো এতো আন্তর্জাতিক ব্র‍্যান্ডিংয়ের মাঝে একটুকু মাতৃভাষার আস্বাদ। এই আস্বাদের আকুতিটাই সীমানা পেরিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে গড়িয়ে গিয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কার্ডিফের স্টেডিয়ামগুলোতে।

সাক্ষী থেকেছে টাইগারদের উচ্ছ্বসিত কলরবের। স্টেডিয়ামজুড়ে বাংলা হরফে লেখা ‘চট্টগ্রাম’ – যেন অচিনপুরের নিজের চেনাটুকুকে আঁকড়ে ধরা,যেন বহুদিন পরে বিজন কোণে কাছের একজনের সাথে দেখা হওয়া। মেলার অজস্র ভিড়ের মাঝে চেনামুখকে খোঁজার খিদেতেই তখন চলতো বাংলাদেশের ক্রিকেট দেখা।

বাংলাদেশকে দেখার আরেকটা কারণ হলো ওই গোছা গোছা কালো কালো মাথাভর্তি স্টেডিয়ামের একসাথে লাফানো, একসাথে ঝাঁপানো, একসাথে কান্না, একসাথে হেসে ওঠা। ‘কাংলু’, ‘নাগিন ডান্স’, ‘নো বল’ তামাশার কুয়াশায় ঢেকে আমরা বরাবর আড়াল করতে চেয়েছি তামাম বাংলাদেশের খেলার মাঠে কাঁধে কাঁধ মেলানোটাকে, ডেভিড হোয়াটমোরের মতো কোচকে এনে বোর্ডের আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টাকে এবং হালের ক্রিকেটনীতি অনুযায়ী সিনিয়রপ্রথাকে বর্জনের মাধ্যমে আত্মোত্তরণটাকে।

আর সবথেকে বেশি যেটা আড়াল করতে চেয়েছি ঘষে ঘষে ঝলসে ওঠা একঝাঁক বাংলাদেশির ক্রিকেট প্রজ্ঞাকে।বাংলাদেশ এবার খোদ দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সিরিজ জিতলো। অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডকে টুকটাক হারানোটা যে বাংলাদেশের শিরোনাম হতো তারা আজ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে, এশিয়া কাপে রানার আপ হয়, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলে, যুব বিশ্বকাপ জেতে।

আকরাম খান, হাবিবুল বাশার, আশরাফুল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, থেকে আজকের তারুণ্য — ব্যাটন হাতবদলি হতে হতে শক্তির যে ক্রমোন্নতি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তো বাংলাদেশের ক্রিকেটই। তাই এই রাতে বাংলাদেশের যে অর্জন সেটা কিন্তু নামজাদা কোনও শিরোপা অর্জনের চেয়ে কম কিছু নয়। তাই তাদের লাগামছাড়া উচ্ছ্বাসে তীর্যক দৃষ্টি না হেনে যদি তাদের প্রজ্ঞাকে, প্রক্রিয়াকে, প্রয়াসকে মান্যতা দিই তাতে ক্ষতি কি!

তিল তিল করে যে সুন্দর হয়, সেই তো তিলোত্তমা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link