টানা দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপ জয়ের মিশনে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ফ্রান্স। ২০১৮ সালের পর ২০২২ সালেও বিশ্ব মঞ্চে জয়ের কেতন উড়ানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ফরাসিরা পৌঁছে গিয়েছে সেমিফাইনালে। আর এই যাত্রায় বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ২৩ বছর বয়সী এক তরুণ প্রতিভা, তাঁর নামটা যে কিলিয়ান এমবাপ্পে সেটা আলাদা করে না বললেও বোধহয় বোঝা যায়।
বিশ্বকাপের এবারের আসরে মাত্র পাঁচ ম্যাচেই পাঁচ গোল করেছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে, আছেন সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় সবার উপরে। সেই থেকে সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরো দুই গোল।
সংখ্যাতত্ত্ব পাশে সরিয়ে চর্মচোখে খেলা দেখলেই বোঝা যায় কিলিয়ান এমবাপ্পের আধিপত্য; প্রতি ম্যাচেই গতি, স্কিল আর দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ে বারবার এমবাপ্পে নজর কাড়েন সবার৷ বলাই যায়, এবারের ফ্রান্স আক্রমণভাগের নেতৃত্বে আছেন এই পিএসজি ফুটবলার।
২০১৮ সালের বিশ্বকাপেই প্রথমবার লাইমলাইটে এসেছিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। চার গোল করে দলের ট্রফি জয়ে অবদান রেখেছিলেন সামনে থেকে। সবমিলিয়ে তাই বিশ্ব মঞ্চে এই স্ট্রাইকারের গোল দাঁড়িয়েছে নয়টিতে, যা কি না ডিয়েগো ম্যারাডোনা কিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর চেয় বেশি। এভাবে এগুতে পারলে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডও নিজের করে নিতে বেগ পেতে হবে না তাঁর।
অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, পোল্যান্ড – কোন দলেরই জানা ছিল না কিলিয়ান এমবাপ্পের প্রতি উত্তর, সর্বশেষ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে স্কোরশিটে নাম তুলতে না পারলেও ইংলিশদের ডিফেন্সে ভীতি ছড়িয়েছেন এই ফরাসি তারকা।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসির স্বর্ণযুগ প্রায় শেষ। কিলিয়ান এমবাপ্পে যদি সেই শূণ্যস্থান দখল করে নেন তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আরো বিশেষ করে বললে, সেই শূণ্যস্থান এমবাপ্পে দখল না করলেই বরং অবাক হতে হবে। এমবাপ্পের এমন সাফল্য অবশ্য হুট করেই অর্জিত হয়নি। তাঁর প্রতিভা আর পরিশ্রমের মিলনেই ধীরে ধীরে শ্রেষ্ঠত্বের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন ২৩ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার।
কিলিয়ান এমবাপ্পের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নপূরণের প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল এএস বন্ডি নামের একটি স্থানীয় ক্লাবে। শুধু এমবাপ্পে নয়, এখান থেকে বেড়ে উঠেছেন বর্তমানে ফিওরেন্তিনো ক্লাবে খেলা জোনাথন ইকোনি এবং আর্সেনালে খেলা উইলিয়াম স্যালিবা। এমবাপ্পের তৈরি হওয়ার জন্য যেমন পরিবেশ প্রয়োজন ছিল ঠিক তেমনটাই ছিল বন্ডিতে।
অল্প বয়স থেকেই কিলিয়ান এমবাপ্পের সম্ভাবনার কথা ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপে। বড় বড় ক্লাবগুলোর নজরে ছিলো এই ফরাসি। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই এমবাপ্পেকে বিনামূল্যে জুতা প্রদান করতে শুরু করে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নাইকি। দুই বছর পরে তাঁর সাথে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে কোম্পানিটি।
কিলিয়ান এমবাপ্পের বেড়ে উঠার সময়কার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা। বাবা-মা-ই ছিলেন তাঁর প্রাথমিক অভিভাবক তবে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল তাঁকে। তাই হয়তো অন্যদের তুলনায় দ্রুত মানসিক বিকাশ ঘটেছিল এমবাপ্পের৷ এছাড়া আইডল ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, থিয়েরি অঁরিদের সাক্ষাৎকারও দেখতেন তিনি।
কিলিয়ান এমবাপ্পের বিভিন্ন দিক দেখভাল করার জন্য আছে টিম এমবাপ্পে, আর এটির সদস্য সংখ্যা মাত্র ত্রিশজন। বিচ্ছেদ হওয়া সত্ত্বেও এমবাপ্পের বাবা-মা নিজেদের ছেলের ক্ষেত্রে একত্রেই কাজ করে থাকেন। এমবাপ্পের বাবা উইলফ্রেড ছেলের ফুটবলীয় দিক দেখেন, অন্যদিকে মা ফাইজা দেখেন মাঠের বাইরের বিষয়গুলো।
কিলিয়ান এমবাপ্পের সাফল্য লুকিয়ে আছে টিম এমবাপ্পের সিদ্ধান্তের মাঝেই। সমসাময়িক সুপারস্টার নেইমার জুনিয়রের ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে ব্যাপারটা বোঝা যায়, ব্রাজিলিয়ান তারকার জীবনে তাঁর বাবার প্রভাব অনেক বেশি চোখে পড়ে৷ কিন্তু নেইমারের বাবার মত অর্থের লোভে বড় বড় ক্লাব নয়, বরং এমবাপ্পের পরিবার গেম-টাইমের উপর জোর দিয়েছিল, যার সুফল ভোগ করছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে।
পিএসজি ফরোয়ার্ডের কাছে ফুটবল এমন একটি খেলা যার জন্য তিনি শুরু থেকেই নির্দিষ্ট নিয়ম ঠিক করেছিলেন; সেই নির্দিষ্ট পথে হেটেই বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলারে পরিণত হয়েছেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে চব্বিশতম জন্মদিন পালনের আগেই হয়তো দ্বিতীয়বারের মত দেশকেমবিশ্বকাপ জেতাবেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। এমন অর্জনকে বিশেষ বললেও হয়তো কম বলা হবে।