কৃপণতার ভদ্রলোকী ভার্সন

২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের প্রধান নির্বাচক হিসেবে যুক্ত হন অ্যালেস্টিয়ার ক্যাম্পবেল। এরপর ২০১০ সালে তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে জিম্বাবুয়ে। ওই সফরে একদিন উৎসেয়া সর্বোচ্চ এক মিনিট দেরিতে আসায় টিম বাস তাঁকে না নিয়েই চলে যায়! লিয়াজো অফিসারকে তৎক্ষনাৎ বিষয়টা জানালেন তিনি। তখন ওই অফিসার তাঁকে বলেন, ‘আপনি কি জানেন আমি ক্যাম্পবেল, ডেভ হটন ও কয়েকজনকে কিছুদিন আগে লিফট দিয়েছিলাম। তাঁরা সেখানে বলছিল আপনাকে অধিনায়ক হিসেবে দেখতে চায় না।’

জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সেরা অধিনায়ক কে ছিলেন বললে আপনি সবার আগে বলবেন অ্যালিস্টেয়ার ক্যাম্পবেলের নাম। সফলতার দিক থেকে নি:সন্দেহে তিনি শীর্ষে। কিন্তু তার সময়ে জিম্বাবুয়ে দলটাও ছিল নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ফর্মে! দুর্দান্ত এক দল পেয়েছিলেন ক্যাম্পবেল।

ক্যাম্পবেলের পর জিম্বাবুয়ের সেরা অধিনায়কের নাম আসলে থাকবেন প্রসপার উৎসেয়া। ছোটখাটো গড়নের এক নিপাট ভদ্রলোক। বেশ শান্ত স্বভাবের এই উৎসেয়া জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে দিয়েছেন অনেক কিছু। ধ্বংসপ্রায় একটা দলকে তরুন অবস্থায় নিজের কাঁধে চেপে বয়ে বেড়িয়েছেন দীর্ঘদিন। মুখ থুবড়ে পড়া জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে সাহায্য করেছিলেন আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে।

বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়ে লাঞ্চনা-বঞ্চনাও হয়েছে অনেক। তবু ছিলনা কোনো রাগ-ক্ষোভ কিংবা প্রতিবাদী পদক্ষেপ। যেভাবে নিরবে পেয়েছিলেন দলের দায়িত্ব সেভাবে নিরবেই ক্রিকেট ক্যারিয়ার থেকে নিয়েছিলেন বিদায়!

হারারেতে বেড়ে উঠা উৎসেয়ার। প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালীনই ক্রিকেটের সাথে পরিচয়। সেখানে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ডের (জেডসি) ডেভেলপমেন্ট কোচেরা প্রতিভাবান তরুণদের নিয়ে যেতেন অ্যাকাডেমিতে। তবে উৎসেয়া মনে করতেন তিনি একজন ভালো ফুটবলার হতে পারেন। ফুটবল ছিলো তাঁর পছন্দের খেলা। কিন্তু ভ্রমণ করা আর স্কলারশিপ পাওয়ার লোভনীয় সুযোগ তাঁকে ফুটবল থেকে ক্রিকেটে ধাবিত করে। ১৯৯৯ সালে চার্চিল সরকারি স্কুল থেকে স্কলারশিপ পান উৎসেয়া। হারারের সবচেয়ে স্বনামধন্য স্কুল ছিল চারচিল।

সেসময় উৎসেয়া ছিলেন একজন ওপেনার। সেখান থেকে ২০০১ সালে ম্যাশহোনাল্যান্ড এ দলের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। তখন পর্যন্ত একজন ব্যাটার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন উৎসেয়া। এরপর বছরখানেক বাদে অফস্পিন শুরু করেন। বছর দুয়েকের মাঝেই অফস্পিনে সেরা হয়ে উঠেন এই তরুণ তারকা।

ঘরোয়া ক্রিকেটে তখন সম্ভাবনাময়ী এক ক্রিকেটার হিসেবে নামডাক উৎসেয়ার। ব্যাটিং পজিশনটাও চলে আসে লোয়ার-মিডল অর্ডারে! প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকের পর খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি জাতীয় দলের দরজায় পা রাখার জন্য!

২০০৪ সালে কিছু ক্রিকেটারদের স্ট্রাইকে যাওয়া আশীর্বাদ হয়ে আসে উৎসেয়ার জন্য। হিথ স্ট্রিককে অধিনায়কত্ব থেকে অপসারণ করায় ফুঁসে উঠেছিলো সিনিয়র ক্রিকেটাররা। একসাথে ১৫ সাদা চামড়ার ক্রিকেটার ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ায়! বিপাকে পড়ে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট। তখন তরুণ কিছু সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারকে সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আর এতেই ভাগ্য খুলে যায় উৎসেয়ার!

১৯ বছর বয়সে সুযোগ পেয়ে যান জাতীয় দলে। এক বছর বাদে ২০০৫ সালের শেষের দিকে টাটেন্ডা টাইবু হটাৎ জিম্বাবুয়ের অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ান! ভালো গেম অ্যাওয়ারনেস থাকায় তরুণ উৎসেয়াকেই দেওয়া হয় দায়িত্ব। অধিনায়ক হিসেবে শুরুটা করেন দুর্দান্ত। বাংলাদেশকে ৩-২ এ সিরিজ হারায় জিম্বাবুয়ে। আর সেখানে সিরিজ সেরা হন খোদ অধিনায়ক উৎসেয়া!

এরপর টেস্ট ক্রিকেট থেকে সাময়িক সময়ের জন্য নিষিদ্ধ হয় জিম্বাবুয়ে। ওয়ানডেতেও তখন দলের অবস্থা চরম বাজে। তবে উৎসেয়া ঠান্ডা মাথায় সব চাপ সামলে নিচ্ছিলেন। চেষ্টা করছিলেন দলের ভালো অবস্থা ফিরিয়ে আনতে। ২০০৭ আইসিসি ওয়ার্ল্ডকাপেও জিম্বাবুয়ের নেতৃত্ব দেন তিনি।

সেসময় জিম্বাবুয়ের অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশ খারাপের দিকে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে পুরো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন ধসে পড়ে। সব মিলিয়ে দলের এমন অবস্থায় উৎসেয়ার উপর চাপটা ছিল অনেক বেশি।

২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের প্রধান নির্বাচক হিসেবে যুক্ত হন অ্যালেস্টিয়ার ক্যাম্পবেল। এরপর ২০১০ সালে তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে জিম্বাবুয়ে। ওই সফরে একদিন উৎসেয়া সর্বোচ্চ এক মিনিট দেরিতে আসায় টিম বাস তাঁকে না নিয়েই চলে যায়! লিয়াজো অফিসারকে তৎক্ষনাৎ বিষয়টা জানালেন তিনি। তখন ওই অফিসার তাঁকে বলেন, ‘আপনি কি জানেন আমি ক্যাম্পবেল, ডেভ হটন ও কয়েকজনকে কিছুদিন আগে লিফট দিয়েছিলাম। তাঁরা সেখানে বলছিল আপনাকে অধিনায়ক হিসেবে দেখতে চায় না।’

মূলত অধিনায়ক হবার সময় কৃষ্ণাঙ্গ শাসিত বোর্ডের অধীনে তিনি দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে শ্বেতাঙ্গরা বোর্ডে আসলে মূলত শুরু হয় কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারদের সরানোর অভিযান।

এরপরই ক্যাম্পবেল ধীরে ধীরে ব্ল্যাক ক্রিকেটার ও কোচদের সরিয়ে সাদা চামড়াকে প্রাধান্য দেন! এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পরের বছর ২০১০ সালে উৎসেয়া অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ান।

২০০৪ সালে টেস্ট অভিষেকে ৪৫ রানের ইনিংস খেললেও বল হাতে দেখা পাননি কোনো উইকেটের। এরপর ৯ বছর টেস্ট ফরম্যাটে দেখা মেলেনি এই তারকার। ২০১৩ সালে সাদা পোশাকে সুযোগ পান উৎসেয়া। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের বিপক্ষে তিন টেস্টে শিকার করেন দশ উইকেট। এরপরই আবার বাদ পড়েন তিনি। সাদা পোশাকের সংক্ষিপ্ত জার্নিটা এখানেই শেষ।

রঙিন জার্সিতে গড়েছেন লম্বা ক্যারিয়ার। টি-টোয়েন্টিতে খেলেছেন ৩৫ ম্যাচ। ব্যাট হাতে সফল না হলেও বল হাতে ৬.৮৭ ইকোনমিতে নিয়েছেন ২৬ উইকেট। অভিষেকেই বাংলাদেশের বিপক্ষে ২৫ রানের বিনিময়ে নেন ৩ উইকেট! জিম্বাবুয়ের হয়ে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার তালিকায় বেশ উপরের দিকে আছেন উৎসেয়া।

অভিষেকের পর থেকে নিয়মিত মুখ ছিলেন ওয়ানডেতে। খেলেছেন ১৬৪ ম্যাচ! ব্যাট হাতে ১৭ গড়ে ১৪০৬ রান, আছে ৪ ফিফটিও। বল হাতে নিয়েছেন ১৩৩ উইকেট! ২০১৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হারারেতে ৩৬ রানে ক্যারিয়ার সেরা ৫ উইকেট শিকার করেন তিনি!

জিম্বাবুয়ের হয়ে ৬৮ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করা উৎসেয়া জয়ের দেখা পেয়েছেন ৩০ ম্যাচে। অর্থাৎ মাত্র ৩০% ম্যাচে জিম্বাবুয়ে তার অধীনে জয় পেয়েছে। বিশের বেশি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করা জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটারদের মধ্যে সফলতার দিক থেকে ক্যাম্পবেলের পর দ্বিতীয়তে আছেন উৎসেয়া।

তাঁর অধীনে বড় দলের (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) বিপক্ষে জয় ছিলো মাত্র দুই ম্যাচে, বাকি সবই সহযোগী দেশগুলোর সাথে! তবুও তিনি জিম্বাবুয়ের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। যে সময় মুখ থুবড়ে পড়েছিল জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট, সেই ক্রান্তিকালে ত্রাতা হয়ে আসেন উৎসেয়া। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এই ভদ্রলোক নি:সন্দেহে আরও বেশি সম্মান পাওয়ার দাবি রাখেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...