ফুটবলের সবচেয়ে বড় আয়োজনের খুব একটা দেরী নেই। আর অল্প কয়েক মাস পরেই কাতারে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ-২০২২। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি বরাবরই পৃথিবীর বুকে অনন্য স্থানগুলোর মধ্যে একটি।
আর বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে নিজেদের দেশকে আরো ঢেলে সাজিয়েছে তারা। গড়ে তুলেছে নতুন নতুন স্টেডিয়াম।অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়াও নিজের দেশে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে এবার এই টুর্নামেন্টে অসাধারণ কিছু প্রযুক্তির ব্যবহার করতে যাচ্ছে কাতার।
- আধুনিক শীতলীকরণ প্রযুক্তি
এক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হয় শীতলীকরণ প্রযুক্তির কথা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ হওয়ায়, স্বাভাবিকভাবেই কাতার বিশ্বের অন্যতম উষ্ণ দেশ। আর তাই খেলার মাঠ ও গ্যালারির তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখার একটা প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। খেলোয়াড় থেকে শুরু করে দর্শকদের জন্যে স্বস্তির এক পরিবেশ সৃষ্টি করাই যার মূল লক্ষ্য। এই কাজে ব্যবহৃত শীতলীকরণ প্রযুক্তি সাধারণ শীতলীকরণ প্রযুক্তির চেয়ে ৪০% অধিক টেকসই এবং শক্তি-সাশ্রয়ী।
এছাড়া এই অত্যাধুনিক কুলিং প্রযুক্তির অসাধারণ একটি ফিচার হলো স্টেডিয়ামে থাকা মানুষের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে তাপমাত্রা নির্ধারণ করা যাবে। বোঝাই যাচ্ছে, স্টেডিয়ামের বাইরের তাপমাত্রা যত বেশি হোক না কেনো, ভিতরে থাকা খেলোয়াড় এবং সমর্থকেরা অন্তত এই কারণে কোনো ধরনের অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়বেন না। এছাড়াও স্টেডিয়ামের বাতাস পরিষ্কার এবং বিশুদ্ধ করার কাজও এই যন্ত্রের সাহায্য করা হবে।
- অস্থায়ী স্টেডিয়াম
কাতারের ইন্টারন্যাশনাল ডায়ালিং কোড হলো +৯৭৪, আবার তাদের রিসাইকেলড শিপিং কন্টেইনার এর সংখ্যাও ৯৭৪। আর এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে দেশটিতে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী ‘স্টেডিয়াম-৯৭৪’। এটির ধারণক্ষমতা প্রায় ৪০,০০০। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটি প্রথম স্টেডিয়াম যা তৈরীই করা হয়েছে পরবর্তীতে সরিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে।
এই অস্থায়ী ভেন্যু পরবর্তীতে আফ্রিকায় অনুন্নত দেশগুলোতে সাহায্য হিসেবে প্রদান করা হতে পারে। এছাড়া কিছু ‘লিগ্যাসি প্রজেক্ট’ সিরিজে ব্যবহার করার জন্য পুন:স্থাপনের সম্ভাবনাও রয়েছে।
- স্মার্ট চার্জিং এবং ওয়াইফাই ব্যবস্থা
কাতার বিশ্বকাপে থাকবে স্মার্ট ওয়াই-ফাই এবং চার্জিং ব্যবস্থা। EIP Palm স্টেশনগুলোতে শেডিং ওয়াইন্ড টার্বাইন সোলার প্যানেল ও বাইফেসিয়াল ফটোভোল্টেক প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এখানে বসে ইউএসবি পোর্টের মাধ্যমে বা ওয়্যারলেসল পদ্ধতিতে মোবাইল ফোন চার্জ করা যাবে।
এছাড়া EIP Palm-এ ওয়াইফাই হটস্পট ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। এডভার্টাইজিং, মিস্ট কুলিং, সার্ভেইলেন্স ক্যামেরা, লাইটিং ও স্পিকার-ও EIP Palm এর অংশ।
- সহজ নেভিগেশন সিস্টেম
একটি কাস্টম-মেড স্মার্টফোনের মাধ্যমে দোহার আশেপাশে থাকা সেন্সর দিয়ে নিজের গন্তব্য খুঁজে নিতে পারবেন ভ্রমনকারী’রা। তাছাড়া ট্রাফিক, টেক্সি, পার্কিং, নতুন মেট্রো সিস্টেম এবং ভেন্যু এনট্রেন্স ও এক্সিট এর তথ্য পাওয়া যাবে এই অ্যাপের সাহায্যে। এর পাশাপাশি স্টেডিয়াম, শপিং সেন্টার ও এন্টারটেইনমেন্ট ভেন্যুর ইনডোর স্পেসে যাওয়ার সহজ পথ বের করা যাবে।
দোহা’র আশেপাশে কানেক্টেড সেন্সর বসানো হয়েছে যার দ্বারা কাতারের আশেপাশে সহজে চলাচল করা যাবে। মেট্রো, টেক্সি, পার্কিং, এন্ট্রেন্স ও এক্সিট পয়েন্ট, ইত্যাদি তথ্য প্রদানে সাহায্য করবে এসব সেন্সর। যার ফলে রিয়েল-টাইম ইনফরমেশন ব্যবহার করে ভ্রমন সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা যাবে। আর এর সবই একটি মাত্র স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে সম্ভব হবে।
- অত্যাধুনিক আলোকসজ্জা
স্টেডিয়ামে এলইডি লাইট একেবারেই নতুন কিছু নয়, কিন্তু কাতার এই সামান্য বিষয়টিকেও একেবারে অনন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই এলইডি লাইট এবার ফুটবল বিশ্বকাপ ২০২২ এ দেখা যাবে। কালার-চেঞ্জিং লাইট এর পাশাপাশি অনেক ধরনের লাইট ইফেক্ট এর ব্যবস্থা করা হয়েছে কাতার বিশ্বকাপের জন্য। আর এগুলো মূলত ওপেনিং ও ক্লোজিং অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হবে।
এসব লাইট সাধারণ লাইটের চেয়ে ৬ গুণ অধিক সময় ধরে কাজ করে। আর সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো এগুলো ‘এনার্জি-এফিসিয়েন্ট’ এবং ‘নন-টক্সিক’।
- ফুড অর্ডার সিস্টেম
স্টেডিয়ামে বসে থাকতে থাকতে ক্ষুধা তো লেগে যেতেই পারে। আর তাই দর্শকদের নিজের সিটে বসেই খাবারের অর্ডার দেয়ার জন্য ফুড টেকনোলজি নিয়ে এসেছে কাতার।
স্মার্টফোন অ্যাপ এর মাধ্যমে ফুড অর্ডার করতে পারবেন মাঠে থাকা সমর্থকেরা। অ্যাপের মাধ্যমে ফুড অর্ডার করার পর ‘এক্সপ্রেস কিউ’-এর মাধ্যমে খাবার সমর্থকদের সামনে পৌঁছে যাবে। এছাড়া দ্রুত খাবার পাওয়ার জন্য পিক আপ অপশনও ব্যবহার করতে পারবেন গ্রাহকেরা।
- পরিধানযোগ্য ইলেকট্রনিকস
ইতোমধ্যে কাজ চলছে এমন কিছু প্রযুক্তির মধ্যে একটি হলো পরিধানযোগ্য ইলেক্ট্রনিকস। গায়ে থাকা শার্ট কিংবা জার্সিতে লাগানো সেন্সরের মাধ্যমেই হার্টবিট বা রক্তচাপ মাপা যাবে।
এই প্রযুক্তির পাশাপাশি আরো অনেক ধরনের পরিধানযোগ্য ইলেকট্রনিকস নিয়ে পরীক্ষা চালানো হচ্ছে, যা কাতার বিশ্বকাপে ফ্যানরা ব্যবহারের সুযোগ পেতে পারেন। বিশেষ মুহুর্তে এই ধরনের পরিধানযোগ্য স্মার্ট ইলেক্ট্রনিকস বেশ কাজে আসতে পারে।
- সেমি-অটোমেটেড টেকনোলজি
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী কাতার বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত সংযুক্ত হতে যাচ্ছে রোবট রেফারি। এই বিশ্বকাপে আরো নিখুঁতভাবে অফসাইড নির্ণয় করতে ইতোমধ্যে রোবট দ্বারা পরীক্ষা চালিয়েছে ফিফা। ইতোমধ্যে সেমি-অটোমেটেড অফসাইড টেকনোলজি ব্যবহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষনাও দিয়েছেন ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কাতার বিশ্বকাপে খেলার মাঠে দেখা মিলবে এসব রোবট লাইন্সম্যানের।
এছাড়া কাতারে ওয়াশরুমগুলোতে সেন্সর যুক্ত কল ব্যবহার করা হয়েছে। যা পানির অপচয় অনেকটা কমিয়ে দেয়। কার্বন নি:সরন কমানোর জন্যও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহন করেছে দেশটি। এসবের পাশাপাশি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতিসহ বিভিন্ন সেন্সস প্রযুক্তির ব্যবস্থা করেছে কতৃপক্ষ।