ছায়ায় ঢাকা দেয়াল

ছোটবেলায় নানান রকমের বাতিক ছিল। এর মধ্যে একটা ছিল, পেপারে ভালো কোন আর্টিকেল দেখলে সেটা কেটে রাখা। এভাবে অনেকগুলো পেপার কাটিং জমেছিলো। স্বাভাবিকভাবেই বেশিরভাগ কাটিঙই ছিল খেলার উপরে। তাদের মধ্যে একটা ছিল রাহুল দ্রাবিড়ের।

রাহুল দ্রাবিড়কে আমি প্রথম চিনি ৯৬ সালের দিকে। সাদা হ্যাট পরে খেলতে নেমেছিলো লিকলিকে এক ক্রিকেটার, নামটাও উচ্চারণ করছিলাম ‘ড্রাবিড’। কালক্রমে সেটাই হয়ে গেলো দ্রাবিড়, সেটাই হয়ে গেলো ‘দ্য ওয়াল’।

সেবার অস্ট্রেলিয়া ভারত সফরে এলো। অস্ট্রেলিয়া তখন যেন এক বুলডোজার, স্টিভ ওয়াহ নামের এক দক্ষ চালকের হাতে পড়ে সামনে যা পাচ্ছে তাকেই গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। অনুমিতভাবে প্রথম টেস্টে গুঁড়িয়েও দিলো ভারতকে। তবে দ্বিতীয় টেস্টে – ওয়েল, ইডেন গার্ডেন্সের সেই টেস্ট নিয়ে কী-ই বা বলা যায় আর? ফলোঅনে পড়ে পঞ্চম উইকেটে ৩৭৬ রানের জুটি গড়লেন লক্ষ্মণ আর রাহুল। লক্ষ্মণ করলেন ২৮১, আর রাহুল করলেন ১৮০। নায়ক দুজনেই, তবে রাহুলের নামের আগে লেগে গেলো ‘পার্শ্ব’ শব্দটা।

অবশ্য তার গোটা ক্যারিয়ারজুড়ে এ-ই তো চলেছে। রাহুল দ্রাবিড় মানেই যেন ছিল ছায়ায় ঢাকা পড়ার নিয়তি। সেই মহাকাব্যিক ইডেন টেস্টের কথা তো আগেই বলা হলো। এর সাথে যোগ করুন, এর বছর দুয়েক আগের কথা। হায়দ্রাবাদের সেই ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বোলারদের তুলোধুনো করলেন শচীন আর দ্রাবিড়; শচীন টেন্ডুলকার করলেন অপরাজিত ১৮৬, দ্রাবিড়ও করলেন ঝকঝকে ১৫৩। কিন্তু দিনশেষে স্তুতিটা বরাদ্দ থাকলো শুধু শচীন নামের সূর্যের জন্যই। রাহুল হয়ে থাকলেন মেঘে ঢাকা তারা!

অথবা এরও ছয় মাস আগের সেই ম্যাচের কথা ভাবুন। বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার সাথে গ্রুপ পর্বের ম্যাচ। মাত্র পাঁচ রানেই চলে ওপেনার গেলেন সদাগোপন রমেশ। আর এরপরেই সৌরভ-রাহুল জুটিতে ঝড় উঠলো টন্টনে। ‘প্রিন্স অব ক্যালকাটা’ খ্যাতা সৌরভ গাঙ্গুলি করলেন ১৮৩, রাহুল করলেন ১৪৫। কিন্তু সৌরভের ইনিংসের সৌরভে ঢাকা পড়ে গেলো দ্রাবিড়ের ইনিংসের সুগন্ধ। অথচ রাহুলের রান্না করা ইনিংসে সৌরভের চেয়ে মশলা কম ছিল না মোটেও!

শচীনের মতো দেবতা ছিলেন না। ছিলেন না ‘নজফগরের নবাব’ বীরেন্দ্র শেবাগের মতো আগ্রাসীও। তাঁর নেতৃত্বও ছিল গড়পড়তা মানের। কিন্তু রাহুল দ্রাবিড় ছিলেন সেই বিশুদ্ধ ব্যাটিং টেকনিকের আরেক নাম, যার ব্যাটিং দেখিয়ে অনায়াসে কোন কোচ তাঁর ছাত্রকে বলতে পারতেন, ‘টেকনিক শিখতে চাইলে রাহুলের খেলা দেখো।’

লিখতে গিয়ে একটা কথা মনে পড়ছে। কে বলেছিলেন, সেটা মনে পড়ছে না নিশ্চিতভাবে। ২০০৪ সালের দিকে রাহুলের ক্যারিয়ার যখন মধ্যগগনে, তখন তার সম্পর্কে বলেছিলেন একজন। ‘শচীন তা-ও আউট করার সুযোগ দেয়। রাহুল তা-ও দেয় না।’

যদি ক্রিকেটার হতে চাইতাম, তবে খুব করে চাইতাম একজন রাহুল দ্রাবিড় হতে। দল বিপদে পড়লেই যিনি দাঁড়িয়ে যেতেন বুক চিতিয়ে, যার ব্যাট চওড়া হতে হতে হয়ে যেতো বাইশ গজের এক মহাপ্রাচীর। ব্যাট হাতে যিনি হয়ে যেতেন অলঙ্ঘনীয় এক ‘ওয়াল’।

ছায়ায় ঢাকা এক দেয়াল, শুধুমাত্র বিপদে পড়লেই যার দেখা পাওয়া যায়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link