বিশ্বকাপের নায়ক থেকে উদ্ভট সমালোচক

‘আমি তোমার বাংলা ভাষা জানি না, তুমি কি ইংরেজিতে বলবে?’ – ২০১৬ পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল) এক ম্যাচ শেষে ম্যাচ সেরার পুরস্কার নেওয়ার পর সাক্ষাৎকারে তামিম ইকবালকে এমভাবেই প্রশ্ন করেন সাবেক পাকিস্তানি ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার রমিজ রাজা। এতে রমিজের উপর বেশ ক্ষুব্ধ হন বাংলাদেশি ক্রিকেট সমর্থকরা। অবশ্য রমিজের এমন উদ্ভট ঘটনা ঘটানো নতুন কিছ নয়।

বরাবরই কমেন্ট্রিতে তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে কট্টর সমালোচনা করে আসছেন। ২০০৩ সালে মুলতান টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ প্রায় জিতেই যাচ্ছিলো! সেদিনও কমেন্ট্রি বক্সে অনবরত পাকিস্তানের প্রতি অতি-পক্ষপাতই করে যাচ্ছিলেন তিনি। মোহাম্মদ রফিকের স্পোর্টসম্যানশিপে অনন্য দৃষ্টান্তে সেদিন ১ উইকেটের কষ্টার্জিত জয় পায় পাকিস্তান। শেষদিকে মোহাম্মদ রফিক বল করার আগেই পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান উমর গুল ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসে! সুযোগ পেয়েও সেদিন আউট করেননি রফিক।

তবুও বাংলাদেশকে নিয়ে কোনো প্রশংসনীয় শব্দ উচ্চারণ করেননি রমিজ। বরং আপত্তিকর মন্তব্য দিয়ে মেতে উঠতেন ছেলেখেলায়। ২০০৩ সে তো বহু পুরোনো কথা। এইতো ৬ বছর আগে গেলো ২০১৫ বিশ্বকাপেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১০৫ রানের বড় জয় পায় বাংলাদেশ।

কিন্তু, ম্যাচ চলাকালীন কমেন্ট্রি বক্সে অনবরত বাংলাদেশকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে যাচ্ছিলেন রমিজ। বাংলাদেশে ক্রিকেটে পরিবেশ নেই, আফগানরা বাংলাদেশের চেয়েও ভালো ক্রিকেট খেলে; এমন ভাবেই কটাক্ষ করে যাচ্ছিলেন তিনি। সুযোগ পেলেই কমেন্ট্রি বক্সে মাইক হাতে বাংলাদেশের দুর্নাম ছড়াতে তিনি মোটেও কার্পণ্য বোধ করেন না।

শুধু বাংলাদেশ বিদ্বেষ নয়, ধারাভাষ্যে তাঁর নানা সময়ে বলা উদ্ভট সব মন্তব্য বরাবরই আলোচনার রসদ যুগিয়েছে। আর সেই আলোচনায় অনেকটাই হারিয়ে গেছে তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার।

পাকিস্তানের হয়ে ১৯৯২-এর বিশ্বকাপজয়ী টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে অনবদ্য অবদান রাখেন রমিজ। ওই টুর্নামেন্টে ৫৮ গড়ে ৩৪৯ রান করেন তিনি! যা ছিলো টুর্নামেন্টের পঞ্চম সর্বোচ্চ ও পাকিস্তানের হয়ে দ্বিতীয়। ওই টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত দুটি সেঞ্চুরি করেন রমিজ। ডেভিড বুনের পর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে সেবার দুই সেঞ্চুরি করেন তিনি। তার মধ্যে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করার মধ্য দিয়ে স্যার ভিভ রিচার্ডসের পর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে তিন সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েছিলেন তিনি।

রমিজ এই রেকর্ড গড়েছিলেন মাত্র ১৩ ম্যাচ খেলেই! যেখানে ভিভ রিচার্ডস নিজের খেলা চতুর্থ বিশ্বকাপে ১৯তম ম্যাচে এসে তৃতীয় সেঞ্চুরির দেখা পান। অবশ্য ওই টুর্নামেন্টের শেষ বলে ক্যাচ লুফে নিয়ে রমিজ গড়েছিলেন আরেক কীর্তি। প্রথম ফিল্ডার হিসেবে বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের শেষ বলে ক্যাচ লুফে নেন তিনি। তাঁর সেই ক্যাচেই শিরোপা জয় করে পাকিস্তান। সাবেক অজি ক্রিকেটার ড্যারেন লেহম্যান অবশ্য এই তালিকার দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে নাম তুলেন। ২০০৩ বিশ্বকাপে এমন কীর্তি গড়েছিলেন লেহম্যান।

১৪ আগস্ট, ১৯৬২। ফয়সালাবাদে এক ক্রিকেট পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রমিজ রাজা। ১৪ আগস্ট – পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস হিসবে পালিত হয়। আর পাকিস্তানের ১৫ তম স্বাধীনতা দিবসেই জন্ম নেন রমিজ। তিন ভাইর মধ্যে রমিজ ছিলেন সবার ছোট।

বড় দুই ভাই ওয়াসিম রাজা ও জায়িম রাজা পাকিস্তানের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেছেন। এমনকি বাবা সেলিম রাজাও মুলতানের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন। তবে রমিজের বড় ভাই ওয়াসিম রাজা পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়েও ৫৭ টেস্ট ও ৫৪ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন।

রমিজ ছোটবেলা থেকে পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী ছিলেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করার পর ব্যাংকে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন রমিজ। আমেরিকান এক্সপ্রেসের হয়ে ব্যাংকে চাকরিও করেন তিনি। এর পরই ক্রিকেটের তাড়নায় চাকুরি ছেড়ে চলে আসেন মাঠে।

১৯৭৮ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। এরপর ছয় বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে অজস্র রান করে জায়গা করে নেন জাতীয় দলে। ১৯৮৪ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট দিয়েই জাতীয় দলে অভিষেক রমিজের। ওপেনার হিসেবে তাকে ভাবা হচ্ছিলো পাকিস্তান ক্রিকেটের পরবর্তী মজিদ খান। হ্যাঁ, সেই মজিদ খান যিনি ন্যটিংহামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ইতিহাসে পাকিস্তানের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরি করেন। তার সময়ে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানদের একজন ছিলেন মজিদ খান।

অবশ্য রমিজ রাজা মজিদকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি। লেগ সাইডে দুর্দান্ত খেলতেন তিনি। এমনকি স্কোয়ার লেগের উপর দিয়ে ফ্লিক শট সেসময়ে সিগনেচার স্ট্রোক হিসেবেও আখ্যা পায়। তবে সাদা পোশাকে তিনি ছিলেন বেশ অনুজ্জল। ৫৭ টেস্টে মাত্র ৩২ গড়ে ২৮৩৩ রান করেন রমিজ।

ওপেনিং কিংবা তিন নম্বরে ব্যাট করে তিনি করেছেন ৩১ গড়ে ২৩৮৬ রান; যা কিনা এই পজিশনে সবচেয়ে বাজে গড়ের দিক থেকে বিশ্বক্রিকেটে পঞ্চম এবং পাকিস্তানের হয়ে সবচেয়ে বাজে গড়! অবশ্য বাজে গড়ের দিক থেকে তিনি পেছনে ফেলেছেন গ্র‍্যান্ট ফ্লাওয়ার (২৯.২৯), রোশান মাহানামা (২৯.৮৭), কৃষ্ণমচারী শ্রীকান্ত (২৯.৮৮) এবং গ্রাহাম ডোলিংকে (৩০.৯১)।

সাদা পোশাকে ব্যর্থতার স্পষ্ট ছাপ থাকলেও রঙিন জার্সিতে আপন রঙে রাঙাতে পেরেছেন রমিজ। টেস্ট অভিষেকের এক বছর পরই ১৯৮৫ সালে রঙিন জার্সিতে অভিষিক্ত রমিজ ১৯৮ ওয়ানডেতে ৩২ গড়ে করেছেন ৫৮৪১ রান। যার মধ্যে আছে ৯ সেঞ্চুরি ও ৩১ ফিফটি। তবে বিশ্বকাপ আসর মানেই রমিজের জন্য বিশেষ কিছু। বিশ্বকাপের মঞ্চ পেলেই জ্বলে উঠেন তিনি। বিশ্বকাপে ১৬ ম্যাচে ৫৪ গড়ে করেছেন ৭০০ রান! পাকিস্তানের ৯২ এর বিশ্বকাপ জয়ে রমিজের অবদান নেহাৎ কম নয়।

তিনি বেশ কিছু ম্যাচে পাকিস্তানের হয়ে অধিনায়কত্ব করেন। এরপর ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে ২০০৩ সালে দায়িত্ব পান পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) সিইও হিসেবে! তবে মিডিয়ার সমালোচনার মুখে বেশি সময় থাকতে পারেননি গদিতে। সেখান থেকে সরে দাঁড়িয়ে যোগ দেন কমেন্ট্রিতে। তবে, তিনি দুর্দান্ত একজন ক্রিকেট প্রশাসক। ইমরান খানের আস্থাভাজন এই সাবেক ক্রিকেটার চেয়ারম্যান হিসেবে পিসিবিতে ফিরে রীতিমত পাকিস্তান ক্রিকেটের ভোলই পাল্টে ফেলছেন।

পাকিস্তানের হয়ে ১৯৮৭ ও ১৯৯২ দুই বিশ্বকাপেই অনবদ্য পারফরম করেন রমিজ। সাদা পোশাকের ক্যারিয়ারটা বড্ড সাদামাটা হলেও বিশ্বকাপ মঞ্চে তিনি ছিলেন এক অন্য রমিজ। তবুও সেসব ছাপিয়ে ক্রিকেট দুনিয়ায় তিনি এখন স্রেফ ধারাভাষ্যকার।

আর সেখানে আলোচনার চেয়ে, সমালোচিতই বেশি হন তিনি। অবশ্য ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে এই মানুষটার জীবনই বেশ সাফল্যমণ্ডিত। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) চেয়ারম্যানও ছিলেন। ইমরান খানের প্রিয়পাত্র হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আনেন তিনি পাকিস্তানের ক্রিকেটে। যদিও, সেই জীবন শেষ করে তিনি আবারও ফিরে গেছেন ধারাভাষ্যকক্ষেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link