রিডিং দ্য অপনেন্ট

ছেলেবেলায় যখন প্রথম শুনেছিলাম, ওয়াসিম আকরাম এক ওভারে ছয় ধরনের ডেলিভারি দিতে পারেন, অবাক হয়ে ভাবতাম, ব্যাটসম্যানরা তাকে কিভাবে খেলতে পারে? আবার যখন শুনেছিলাম, শচীন সব ধরনের বল খেলতে পারে, তখন ভাবতাম, বোলাররা তাকে কিভাবে আউট করতে পারে? পরে বুঝেছিলাম, ব্যাটিংয়ে দুর্বলতা প্রায় না থাকা কিংবা ভিন্ন ভিন্ন বোলিং অস্ত্র অনেক খেলোয়াড়ের মধ্যেই থাকে।

সেরাদের বাকিদের থেকে আলাদা করে ফেলে খেলার মাঠে তার মস্তিষ্কের ব্যবহার। পরিস্থিতি বুঝতে পারা, প্রতিপক্ষের দুর্বলতা বুঝতে পারা, প্রতিপক্ষকে তার শক্তির জায়গা থেকে সরিয়ে নিজের শক্তির জায়গায় নিয়ে আসার এই গুনগুলোই একজন সেরা খেলোয়াড়কে বাকিদের থেকে আলাদা করে।

যখন দুই সেরা লড়াইয়ে নামেন, দেখা মেলে একের পরে এক স্ট্র‍্যাটেজির। লড়াইটা অন্যের উপরে চালিয়ে দেয়া, ওয়েটিং গেম, চ্যানেল গেমসহ অসাধারণ সব স্ট্র‍্যাটেজি। চলে এটাক এবং কাউন্টার এটাকের খেলা। নির্দিষ্ট দিনে যিনি বুদ্ধিমত্তা বেশি দেখাতে পারেন, তিনিই সেই দিনের বিজয়ী। এভাবেই তৈরি হয় ভিভ রিচার্ডস-লিলি, শচীন-ম্যাকগ্রা, শচীন-শোয়েব বা শচীন-ওয়ার্ন, ওয়াসিম-ওয়াহ, লারা-মুরালির মত ধ্রুপদী সব লড়াইয়ের।

কেতাবি ভাষায় প্রক্রিয়াটির নাম ‘রিডিং দ্য অপনেন্ট’, প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা-দুর্বলতা বুঝতে পারা। ব্যাটসম্যান কিংবা বোলার, উভয়ের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আজকের আলোচনায় কেবলমাত্র একজন বোলার কিভাবে প্রতিপক্ষকে ‘রিড’ করতে পারেন, তা নিয়েই আলোচনা করব।

ধরুন, ডেল স্টেইন বোলিং করছেন। নিশ্চিতভাবেই একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে আপনি জানেন, একের পর এক আউট সুইংগার আসতে থাকবে। অফ স্ট্যাম্প কিংবা সামান্য বাইরে বলটি ল্যান্ড করে বের হয়ে যেতে থাকবে। খেলতে খেলতে আপনি স্বচ্ছন্দ হয়ে গেলেন, সামনের পা অ্যাক্রস দ্যা স্ট্যাম্প চলে যাচ্ছে বলের সুইং মোকাবেলা করার জন্য।

আপনিও জানেন ডেল স্টেইন ইনসুইংগারে ততটা সাবলীল নন কিংবা অবচেতনভাবেই আপনার শরীর আউট সুইংয়ের জন্য অ্যাডজাস্ট হয়ে গিয়েছে। ঠিক সেই মূহুর্তে একটা স্ট্রেটার বল আপনাকে বিপদে ফেলে দিতে পারে। নিউজিল্যান্ডে ওয়ানডে সিরিজে বোল্টের স্ট্রেইটারে তামিমের এলবিডব্লু হওয়ার কথা মনে আছে? উপরের অবস্থার সাথে মিলিয়ে দেখুন, বোল্ট তামিমের অ্যাক্রোস দ্যা স্ট্যাম্প পা নিয়ে খেলার কথা জানতেন, তিনি ঠিক এভাবেই তামিমকে সেট করেছিলেন।

প্রক্রিয়াটির জন্য সব সময়ই যে আপনাকে এমন লম্বা সময় ধরে ব্যাটসম্যানকে সেট করতে হবে তেমনও নয়। মনে করে দেখুন, ৯৯ সালের ভারত-পাকিস্তান এর মধ্যকার কলকাতা টেস্টে শোয়েব আখতার, রাহুল দ্রাবিড়কে একটানা অফস্ট্যাম্পের বাইরে বোলিং করে যাচ্ছিলেন।

যখন দ্রাবিড়ের ফ্রন্ট ফুট অভ্যাসবশত অফ স্ট্যাম্পকে কাভার করে বলের লাইন মোকাবেলা করছিল, তখন শোয়েব মিডল-লেগ স্ট্যাম্প বরাবর ইয়র্কার ছোঁড়েন। দ্রাবিড় সময়মত ব্যাট নামাতে পারেননি, তার পা ব্যাটের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, বোল্ড হয়ে যান। ঠিক তার পরের বলেই শচীন টেন্ডুলকারও প্রায় একই ধরনের বলে বোল্ড আউট হন।

পরবর্তীতে শোয়েব বলেছিলেন, রান আপের সময় তিনি খেয়াল করেন, স্বাভাবিকের থেকে সেদিন শচীনের ব্যাট-প্যাডের মধ্যে কিছুটা বেশি গ্যাপ ছিল। তিনি সেটিই কাজে লাগাতে চেয়েছেন। এই যে দুর্বলতাটা খেয়াল করা গেল, সেটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করা গেল, এর নামই ‘রিডিং দ্য অপনেন্ট’।

আবার, এই প্রক্রিয়ায় আপনি যে সব সময় সফল হবেনই, তেমনও নয়। কোন একদিন একজন ব্যাটসম্যান হয়তো এই প্রক্রিয়াটি আরও ভালোভাবে ব্যবহার করবেন, সেদিন তার উইকেট নেয়াটা হয়তো দুরূহ হয়ে পড়বে। যেমনভাবে, ২০০৩-০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ায় কাভার ড্রাইভ করতে গিয়ে শচীন বারবার আউট হচ্ছিলেন। যে কারনে, সিডনিতে সেঞ্চুরি করার আগ পর্যন্ত তিনি কোন কাভার ড্রাইভ করেন নি।

অস্ট্রেলিয়ান বোলাররা ড্রাইভ করানোর জন্য একের পর এক বল করে গিয়েছেন, শচীন লিভ করেছেন। বোলাররা বাধ্য হয়েছেন শরীরের মধ্যে বল করতে, ফলে অফ সাইডের ফিল্ডাররা খেলার বাইরে চলে যান। বাকিটা সহজ ছিল, স্ট্রেইট ব্যাটে খেলে রান তুলেছিলেন ২৪১। সেদিন শচীন অপনেন্ট রিড করার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়দের ট্রাম্পকে ওভারট্রাম্প করেছিলেন। তারপরেও এর বিকল্প নেই, প্রতিনিয়ত ব্যাটসম্যানকে রিড করতে পারার ক্ষমতা আপনাকে শানিত করতে হবে।

একজন ব্যাটসম্যানকে দুইভাবে রিড করা যায়।

১. ভিজিবল অ্যাট্রিবিউটস বা যা দেখা যায়। ব্যাটসম্যানের টেকনিক, স্ট্যান্স, ফুটওয়ার্ক, স্কোরিং এরিয়া, এগুলোর উপরে ভিত্তি করে ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা নির্ধারণ করা এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করা। যেমন, ইনিংসের শুরুতে রোহিত শর্মা চতুর্থ স্ট্যাম্পের বলে নড়বড়ে, বিরাট কোহলি ষষ্ঠ স্ট্যাম্পের বলে, মরগান শর্ট পিচ বল পছন্দ করেন না, স্মিথ শরীরের মধ্যের বল পছন্দ করেন না।

আবার, যে ব্যটসম্যানরা ব্যাক শাফল করে আগেই ফ্রন্ট ফুটে শরীরের ভর চাপিয়ে দেন, তারা আর ফ্রন্ট ফুটে আসতে পারেন না। যারা ব্যাকফুটে দাঁড়িয়ে থাকেন, তারা আর পেছাতে পারেন না, এই পর্যবেক্ষণগুলো করতে পারলে সেই অনুযায়ী বোলিং করা যায়।

২. ইনভিজিবল এট্রিবিউটস বা যা খেলার সময় দেখা যায় না, বোলারকে অনুধাবন করতে হয়। যেমন, ব্যাটসম্যানের হিস্টরি, মাইন্ডসেট, স্ট্রাইক রেট/রোটেশন প্রসেস, এগুলো। একজন ব্যাটসম্যানের উপর প্রেশার ক্রিয়েট করা হলে, তিনি প্রেশার রিলিজ হিসেবে কোন শট খেলেন, সেটি বন্ধ করা, যিনি স্ট্রাইক রোটেট করা ইনিংস বিল্ড আপ করেন, তিনি যে জায়গা গুলোতে খেলে স্ট্রাইক রোটেট করেন সেটি বন্ধ করে দিয়ে বড় শট খেলতে বাধ্য করা কিংবা যিনি বড় শট খেলতে পছন্দ করেন, তার হিটিং জোন থেকে বল সরিয়ে নেয়ার কাজটা এই অংশের অন্তর্ভুক্ত।

এই প্রক্রিয়া কিভাবে কাজ করে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে পোস্টের দৈর্ঘ্য পড়ার মত থাকবে না। আমি কেবল প্রক্রিয়াটির গুরুত্ব জানাতে চাই।

অসম্ভব সম্ভাবনা এবং ব্যতিক্রমী কিছু নিয়ে ক্যারিয়ারের শুরুতে অনেকেই আসেন। কিন্তু অবাধ ভিডিও এনাইলাইসিসের যুগে এতটুকুই যথেষ্ট নয়। এখন প্রায় পাড়ার ক্লাবগুলোর কাছেও একজন করে এনালিস্ট আছেন, কয়েক ম্যাচের মধ্যেই আপনার জারিজুরি তারা বের করে ফেলতে পারেন। আপনাকে প্রতি মুহুর্তে নিজেকে আগের থেকে ছাড়িয়ে যেতে হবে।

আপনাকে খেলাটা বুঝতে হবে, সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে হবে এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলতে পারলেই কেবলমাত্র দীর্ঘ সময়ের জন্য সফল হতে পারবেন। পরিকল্পনাটা না থাকলে আপনি কেবল একের পর এক জোরে বল ছোড়া আর একের পর এক কাটারই করে যেতে পারবেন। দীর্ঘ পরিসরে কোন ভালো ফল আসবে না। একজন ফিজ-তাসকিনের সাথে রাবাদা-কামিন্সদের পার্থক্য এভাবেই তৈরি হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link