লিভারপুল যদি হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তবে ‘নাদের মাঝি’ চরিত্রে থাকবেন মোহামেদ সালাহ। নাদের মাঝি সুনীলকে কথা দিয়েছিল তিন প্রহরের বিল ঘুরিয়ে আনবে কিন্তু বছরের পর বছর কেটে গেলেও কথা রাখেনি সে। মাঝির মতই অলরেড ভক্তদের প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা করলেও রাখতে পারেননি মিশরীয় তারকা সালাহ। ভিনিসিয়াস জুনিয়রের একমাত্র গোলে তার দল আবারো হেরেছে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে।
অবশ্য সালাহ কথা রাখেননি বললে ভুলই বলা হয়। বরং বলতে যায় তিনি পারেননি; গোলরক্ষক যদি অতিমানব হয়ে উঠে তবে কার সাধ্য হবে জালের ঠিকানা খোঁজার? রিয়াল মাদ্রিদ গোলরক্ষক থিবো কোর্তায়া আজ তেমনই অতিমানব হয়ে উঠেছেন। পুরো ম্যাচে নয়টি সেভ করা এই বেলজিয়ান, শুধুমাত্র সালাহর নিশ্চিত গোলই ঠেকিয়েছেন চারটি। শুধু গ্লাভস নয়, হাত, পা কিংবা মাথা – প্রায় পুরো শরীর দিয়েই লস ব্ল্যাঙ্কোসদের জাল অক্ষত রেখেছেন থিবো কোর্তোয়া।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল বলে কথা, খেলা শুরু হওয়ার আগেই স্টেডিয়ামে ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তাপ। দর্শকদের মাঠে ঢুকতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ায় ৩৫ মিনিট পিছিয়েও যায় খেলা শুরুর ক্ষন। আর খেলা শুরুর পর থেকে উত্তাপ ছড়াতে থাকে দুই দলের বাইশজন খেলোয়াড়। তবে ম্যাচের শুরুর দিকে কিছুটা নিষ্ক্রিয় ছিল রিয়াল মাদ্রিদের আক্রমণভাগ। দলটির ডিফেন্সের পরীক্ষা নিতেই ব্যস্ত ছিল দিয়াজ-মানেরা।
বল পায়ে বারবার আক্রমনে উঠে এসেছিল ইংলিশ ক্লাবটি। প্রথমার্ধে রিয়াল মাদ্রিদের যেখানে কোন অন টার্গেট শট ছিল না, সেখানে গোলমুখে দশটির বেশি শট নিয়েছিল অলরেডরা। অবশ্য আক্রমন শানানোই সার, কাজের কাজ কিছুই করতে পারেনি তারা। প্রতিবারই আটকে গিয়েছে মহাপ্রাচীর হয়ে উঠা কোর্তোয়ার সামনে।
বিশেষ করে ১৬ এবং ২১ মিনিটের মাথায় সালাহ এবং মানের শট হয়তো অন্য যে কোনদিন গোল হতো। কিন্তু আজ দুইবারই আশাহত হতে হয়েছে তাদের। বিরতিতে যাওয়ার আগে অবশ্যই হঠাৎই কাউন্টার এটাকে গোল করে বসে রিয়াল মাদ্রিদ। তবে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি অফসাইডের সিদ্ধান্ত দেন। অবশ্য এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক করার অবকাশ রয়েছে।
বিরতি’র পরেই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয় রিয়াল মাদ্রিদ। শুরু থেকে যেখানে লিভারপুলের আক্রমন থামাতে ব্যস্ত ছিল তারা, সেখানে ধীরে ধীরে নিজেরাও গোলের সন্ধান করতে শুরু করে। ম্যাচের বয়স যখন ৫৯ মিনিট, তখন ডান প্রান্ত থেকে ফেদেরিকো ভালভার্দের জোরালো নিচু একটি ক্রস খুজে নেয় ফাঁকায় দাঁড়ানো ভিনি জুনিয়রকে। গত বছর হলে হয়তো এমন সুযোগও মিস করতেন এই ব্রাজিলিয়ান। তবে সময় বদলেছে, বদলেছে ভিনি’র ফিনিশিং দক্ষতাও। আর তাই খালি জালে বল জড়াতে ভুল হয়নি তাঁর।
ওখানেই শেষ; গত ছয়টি ইউরোপিয়ান টুর্নামেন্টের ফাইনালের মতই একটি গোলই শিরোপা নির্ধারন করে দিয়েছে। নিজেদের ক্লাব ইতিহাসের ১৪ তম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছে রিয়াল মাদ্রিদ। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সফলতম দল এসি মিলানের চেয়ে এখন স্প্যানিশ জায়ান্টদের শিরোপা-সংখ্যা দ্বিগুণ। এছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে নিজেদের সর্বশেষ আট ম্যাচে হারের মুখ দেখেনি দলটি।
আর এতদিন সর্ব্বোচ্চ চ্যাম্পিয়ন্স লিগজয়ী ফুটবলারের তালিকায় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ছিলেন সবার উপরে। এবার নিজেদের ক্যারিয়ারের পঞ্চম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতে রোনালদোকে ছুঁয়ে ফেলেছেন নয়জন রিয়াল মাদ্রিদ তারকা। লুকা মদ্রিচ, ইসকো, মার্সেলো, বেনজেমার নাম রয়েছে সেই তালিকায়।
রিয়াল মাদ্রিদ তো রেকর্ড ভাঙা-গড়ার খেলা খেলছে অনেক দিন। তাদের পাশাপাশি প্যারিসের এই রাতে অনন্য কীর্তি গড়েছেন রিয়াল বস কার্লো আনচেলত্তির। ২০০৩ এবং ২০০৭ সালে দুইবার মিলান এবং ২০১৪ ও ২০২২ সালে দুইবার রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে মোট চারটি শিরোপা জিতেছেন ইতালিয়ান কোচ।
চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের এমন রেকর্ড আর কোনো কোচের নেই। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছে জিনেদিন জিদান আর বব পাইসলে। অবশ্য এখানেই থেমে নেই, খুঁজতে গেলে দেখা যাবে খেলোয়াড় হিসেবে দুইবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার স্বাদ পেয়েছেন আনচেলত্তি। সবমিলিয়ে ছয়টি ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় ছড়েছে কার্লো’র।
রাউন্ড অব সিক্সটিনে প্যারিস সেন্ট জার্মেই, এরের চেলসি, ফাইনালের আগে ম্যানচেস্টার সিটি আর সবশেষে লিভারপুলে – উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে আর কোন দলকে ট্রফি জয়ের জন্য এতটা দুর্গম পথে হাঁটতে হয়নি। সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্লভ হয়েই ১৪তম রূপালি ট্রফিটি স্পেনে যাচ্ছে।
আসরের শুরুতে ট্রফির দাবিদার হিসবে যতটা উচ্চারিত হয়েছে ম্যানসিটি কিংবা পিএসজি’র নাম, ততটা শোনা যায়নি রিয়াল মাদ্রিদের কথা। প্রায় প্রতিটি ম্যাচের আগেই তাদের শুনতে হয়েছে বিদ্রুপ; কখনো বলা হয়েছে পিএসজি থামিয়ে দিবে তাদের, কখনো বা বলা হয়েছে চেলসি, ম্যানসিটি রিয়ালকে ছিঁড়ে খাবে। সবশেষ ফাইনালেও লিভারপুলকে ফেভারিট মেনেছিল ৬৫% দর্শক। কিন্তু দলটা রিয়াল মাদ্রিদ। আর তাই হয়তো সম্ভব, সম্ভব প্রতিটি লড়াইয়ে বিশ্লেষকদের ভুল প্রমান করে দেয়া।
ম্যাচের পর ম্যাচ অলৌকিক সব কাণ্ডকীর্তি ঘটেছে। বিধাতা হয়তো আগেই রিয়াল মাদ্রিদকে চ্যাম্পিয়ন নির্ধারন করে রেখেছিল। টুর্নামেন্টের প্রথম হোম ম্যাচে নবাগত শেরিফ তিরাসপোলের কাছে হার থেকে শুরু, এক বছরের লম্বা সময়টা প্যারিসে এবার জয় দিয়ে শেষ। বিশ্বের চারদিকে থাকা মাদ্রিদিস্তারাও হয়তো শুরুর দিকে ভাবেননি এবারের মৌসুমে ইউরোপে সেরা হবে অল হোয়াইটরা। আর কিছুটা অপ্রত্যাশিত এই শিরোপা তাদের আগামী কয়েক মাস গল্পের খোরাক জোগাবে নিশ্চিতভাবেই।