সেই দুর্ভেদ্য লন্ডনেই বিজয়ী নিশান

ছয় মে, ২০২১। লন্ডনের স্টামফোর্ড ব্রিজ। রেফারির শেষ বাঁশি বাজার পর নত মস্তকে মাঠ ছেড়েছিল সার্জিও রামোস, করিম বেনজেমা’রা। সেদিন স্বাগতিক চেলসি ফুটবল ক্লাবের বিপক্ষে হেরে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদের। সেদিন শুধু পরাজয়ই নয়, মাঠের খেলায় রিয়াল মাদ্রিদকে রীতিমত উড়িয়ে দিয়েই জিতেছিল লন্ডনের ক্লাবটি।

পৃথিবী আবর্তিত হয়, তার সাথে সাথে পরিবর্তন হয় ক্যালেন্ডারের পাতারও। ক্যালেন্ডারের পাতা পাল্টাতে পাল্টাতে আসে নতুন বছর। নতুন বছরে আবারও মুখোমুখি দেখা হয় রিয়াল মাদ্রিদ এবং চেলসি এফসি’র। এবারও পরিচিত সেই টুর্নামেন্ট; রিয়াল মাদ্রিদের দম্ভের টুর্নামেন্ট উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে এবার যখন মাঠে নেমেছিল রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়রা তখন কি গত বছরের ফলাফল মনে রেখে ছিল? যদি মনে থাকে, তাহলে এবার ম্যাচ শেষে দেখবে পরিবর্তন ঘটেছে স্টেডিয়ামের সেই বিশাল ইলেকট্রনিক বোর্ডে। এবার জয়ী দলের নাম যে ‘রিয়াল মাদ্রিদ’।

লস ব্ল্যাঙ্কোসদের এমন জয়-কে আপনি প্রতিশোধ বলতেই পারেন। গত বছরের পরাজয়ের পরে যখন ড্রয়ের অনুষ্ঠানে আবারো নির্ধারিত হয়েছিল এই দুই দলের লড়াই তখন এমন একটি চিত্রনাট্যই হয়তো ভেবে রেখেছিল রিয়াল সমর্থকেরা। বিশেষ করে চেলসির দুর্ভেদ্য স্টামফোর্ড ব্রিজে চেলসিকে হারানোর স্বপ্নই দেখেছিল স্প্যানিশ জায়ান্টরা।

সব স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়না, তবে রিয়ালকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। দুর্ভেদ্য স্টামফোর্ড ব্রিজেই নিজেদের স্মারক-চিহ্ন স্থাপন করে এসেছে তারা। ম্যাচটি জিতে নিয়েছে ৩-১ গোলে। তবে শুধু ম্যাচ-সামারি দেখলে বোঝা যাবে না ঠিক কতটা বিধ্বস্ত হয়েছিল চেলসি ডিফেন্স। পজেশন কিংবা শট নেয়াতে হয়তো এগিয়ে আছে চেলসি কিন্তু মাঠে রিয়াল মাদ্রিদ তাদের পরিকল্পনার সবটুকু বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে। কাউন্টার এটাক, সলিড ডিফেন্স, মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ সব দিকেই ছিল রিয়ালের জয় জয়কার।

চেলসি-জয়ের নায়ক অবিসংবাদিতভাবেই রিয়াল অধিনায়ক করিম বেনজেমা। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে ঠিক আগের ম্যাচেই করেছিলেন হ্যাটট্রিক; চেলসি’র বিপক্ষে ম্যাচেও তার দিকে চেয়েছিল রিয়াল ভক্তরা তবে এতটা নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করেনি। আগের ম্যাচের মতই এই ম্যাচেও ফ্রান্স স্টাইকার করেছেন হ্যাটট্রিক। গুনে গুনে তিনবার বল পাঠিয়েছেন জালে, যার মধ্যে দুইবারই প্লেসিং হেডের মাধ্যমে।

প্রথম গোলের উৎস দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ভিনি জুনিয়র; এই তরুণ উইঙ্গার বেনজেমা’র সঙ্গে ওয়ান-টু-ওয়ান খেলেই দারুন ভাবে চেলসি’র ডিফেন্স ভেঙ্গে বল নিয়ে এগিয়ে যান ডি-বক্সের দিকে। সেখান থেকেই ডি-বক্সে ভাসানো একটি ক্রসে খুজে নেন বেনজেমা-কে। গোলপোস্ট থেকে প্রায় ষোল গজ দূরে থাকা অবস্থায় এমন ক্রসে অন্য কেউ কি করতো তা হয়তো জানা যাচ্ছে না তবে বেনজেমা যা করেছেন তা অবিশ্বাস্য। ষোল গজ দূর থেকেই বলে মাথা ছুঁয়ে মুগ্ধকর এক ফিনিশিংয়ে দলকে গোল এনে দিয়েছিলেন।

প্রথম গোলের পরই এলোমেলো হয়ে উঠা চেলসি’র ডিফেন্সে মিনিট খানেক পরই আবারো হানা দেয় মাদ্রিদ। এবার মাঠের ডান পাশ থেকে ডি-বক্সে ক্রস পুনরায় খুজে নেয় করিম-কে। কোন ভুল করেননি তিনি, আরো একটি হেডারে ২-০ গোলে এগিয়ে দেন রিয়াল-কে। এবারের অ্যাসিস্ট এসেছিল লুকা মদ্রিচের পা থেকে।

দুই গোলে পিছিয়ে থেকে আবার নতুন করে শুরু করে দ্য ব্লুজ’রা। নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে বারবার আক্রমনে উঠে আসতে শুরু করে। ম্যাচের চল্লিশ মিনিটে প্রথম সাফল্য পায় স্বাগতিক দল। জর্জিনহো’র চমৎকার ভাসানো বলে মাথা ছুঁয়ে রিয়াল মাদ্রিদের গোলরক্ষককে পরাস্ত করেন চেলসি’র স্ট্রাইকার কাই হাভার্টজ। ম্যাচে ফিরে আসে চেলসি, এক গোলে পিছিয়ে থেকেই বিরতিতে যায় তারা।

দ্বিতীয় অর্ধের শুরুতেই অমার্জনীয় ভুল করে বসেন গোলরক্ষক এদুয়ার্দো মেন্ডি। সতীর্থের কাছ থেকে পাওয়া বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে হার্ড প্রেসের মুখে বল তুলে দেন বেনজেমা’র পায়ে। বক্সের বাইরে থেকেই খালি গোল পোস্টে বল পাঠিয়ে হ্যাটট্রিক তুলে নিতে ভুল করেননি তিনি। অবশ্য হ্যাটট্রিক পেতে পারতেন আরো আগেই, বিরতিতে যাওয়ার আগে ভিনিসিয়াসের পাস গোলমুখের সামনে পেয়েছিলেন তবে ভারসাম্য হারিয়ে অন টার্গেট আর রাখতে পারেনি শটটি।

৪৬ মিনিটে বেনজেমার হ্যাটট্রিকের পর আর বদলায়নি ম্যাচের স্কোরলাইন। ৩-১ এ এগিয়ে যাওয়ার পর কিছুটা ডিফেন্সিভ মুডেই চলে গিয়ছিলো সফরকারী’রা। এসময় বেশ কয়েকটি হাফ চান্স সৃষ্টি করলেও ফিনিশিংয়ের অভাবে গোল পাওয়া হয়নি চেলসির। তাছাড়া থিবো কোর্তায়া যেখানে গোলরক্ষক সেখানে গোল দেয়া একটু তো কঠিনই। চেলসির নেয়া কার্যকরী কিছু দূর পাল্লার শট আটকে গিয়েছে এই বেলজিয়ান প্রাচীরের সামনে।

করিম বেনজেমা তো ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে এসে জীবনের সেরা ফর্মে রয়েছেন। পাশাপাশি ব্রাজিলিয়ান ভিনি জুনিয়রের সঙ্গে তার মাঠের সম্পর্ক অন্যরকম। ডিফেন্ডারদের চোখে পলকেই দুজন সৃষ্টি করতে পারেন গোলের সুযোগ। লুকা মড্রিচ, টনি ক্রুসরাও মিডফিল্ড নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে খেলেছেন; ক্যাসেমিরো সহ রিয়ালের ডিফেন্ডাররাও নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছে দূর্দান্তভাবেই; তরুন ম্যাসন মাউন্ট, পুলিসিচদের কোন ভাল সুযোগই সৃষ্টি করতে দেয়নি আলাবা-কারভাহালরা।

ঘরের মাঠে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে টানা পাঁচ ম্যাচ ক্লিনশিট ছিল চেলসির, তাই হয়তো ডিফেন্স নিয়ে চিন্তাও কম ছিল তাদের। কিন্তু ম্যাচে ডিফেন্সই সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে চেলসিকে। এছাড়া এনগোলো কান্তে, রিচ জেমস’রা ভাল খেললেও পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি ম্যাচের ছড়ি। বদলী স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু অবশ্য ক্রস ইন করা বলগুলোতে মাথা ছুঁয়ে ছিলেন কয়েকবার তবে ঠিক টার্গেটে রাখতে পারেননি। তাই নব্বই মিনিট শেষে দুই গোলে পিছিয়ে থেকেই ফিরতে হয় দ্য ব্লুজদের।

এর আগে কখনোই রিয়ালের বিপক্ষে হারেননি চেলসির কোচ থমাস টুখেল, এই ম্যাচে পাওয়া প্রথম পরাজয়ের স্বাদ নিশ্চিতভাবেই তেতো মনে হবে তার কাছে। তবে এখনই শেষ হয়ে যায় নি সবকিছু, দুই লেগের লড়াইয়ের দ্বিতীয় পর্ব তো এখনও বাকি। সান্তিয়াগো বার্নাব্যু-তে এবার আতিথেয়তা নিবে চেলসি। আগামী ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় রাত একটায় দ্বিতীয় লেগে মাঠে নামবে দুই দল। দুই গোলে পিছিয়ে থাকা চেলসি কি ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প মঞ্চায়ন করবে নাকি রিয়াল মাদ্রিদ আবারো কুপোকাত করবে ইংলিশ ক্লাবটি-কে? উত্তর জানার জন্য না-হয় ততক্ষণ অপেক্ষায় থাকুক ফুটবল বিশ্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link