শেষ বলে ছক্কা মেরে ম্যাচ জেতানো যায়, প্রথম দেখেছিলাম ব্রেন্ডন টেলরের ব্যাটে। টানা দুই ছক্কায়ও জয় আসে, এইতো গত বছরের এই রাতেই রাহুল তেওয়াতিয়া দেখিয়েছিলেন। সেই রাহুল তেওয়াতিয়াই এর এক বছর আগে ওভারে পাঁচ ছক্কা মেরে জিরো থেকে হিরো হয়েছিলেন উত্তপ্ত শারজাহর ময়দানে। অথচ এর আগে টুইটার থেকে কমেন্ট্রি বক্স, টিভি সেটের সামনে আমরা; একই প্রশ্ন এই ছেলে ব্যাট করতে পারে নাকি?
অর্ধযুগ আগের ইডেনে তো ফিরতেই ছক্কার সমীকরণ মেলাতে গেলে। কার্লোস ব্রাথওয়েট, বেন স্টোকস। গুণে গুণে চারটা ছক্কা। ইয়ান বিশপ চিৎকার করে সবাইকে জানিয়ে দেন, এই নামটা মনে রেখো। আমরা ভুলিনি এখনো।
ক্রিকেট দেখি অনেকদিন। বুঝেশুনে দেখি খুব বেশিদিন নয়। জাভেদ মিয়াঁদাদের শেষ বলে ছক্কার কথা এখনো সিনিয়রদের মুখে শুনি। এশিয়া কাপে নাসিম শাহও খানিকটা সেই ভাইব দিয়েছিলেন।
কিন্তু এবার যা দেখলেন, যে পরিস্থিতিতে দেখলেন, এমনটা নিশ্চয়ই কেউ দেখেননি এর আগে স্বীকৃত ক্রিকেটে। করার সাহসটাও তো অনেক বড় ব্যাপার। এভাবে ম্যাচ জেতানোর স্বপ্ন দেখতাম আমি, আপনি আর আমাদের ক্রিকেটকাতুরে, ক্রিকেটার হতে চাওয়া ছোট্ট মন। রাস্তায় চলতে ফিরতে ব্যাটিং শ্যাডো, দুই একটা ডেলিভারি করতে থাকা টিনেজারটা।
প্রথমটা ওয়াইডিশ লং অফে, পরেরটা ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে ফ্লিক। পরেরটায় আবার ফুলটস, ঠিকানা সেই লং অফ। চার নম্বর ছক্কাটা? ব্যাক অফ দ্য হ্যান্ড স্লোয়ার, শর্ট অফ লেংথ, ক্রস ব্যাটেড একটা ফ্ল্যাট শটে লং অনে ছয়! সিরিয়াসলি?
আর শেষটা তো দেখলেনই, টেনে এনে একই ঠিকানায় পাঠানো। কানেক্ট করার পর স্ট্রেইট বাউন্ডারির এপাশে থাকা ক্যামেরা জুম আউট করল বলের ট্র্যাজেক্টরির সাথে। দূর থেকে যা দেখা গেল রিংকু সেকেন্ড খানেক দাঁড়িয়ে দৌড়ের প্রিপারেশন নিচ্ছেন ডাগ আউটের দিকে। নিতিশ রানা-ই তো কী একটা বলতে বলতে ছুটে এলেন তার দিকে।
প্রথম ছক্কাটা মারার পর ব্যাটিং পার্টনারের সাথে কথাও বলেননি। আলাদা একটা জোনে চলে গিয়েছিলেন। নার্ভাস মনেই হয়নি একদম, তাও গুজরাটের হোম ক্রাউডের সামনে। হিটিং আর্কে আজ যা আসবে তাই পেটাব; মোটিভ। না আসলেও পেটাব। আসলেই তো, বাইরের বল টেনে এনে অনায়াসে ছক্কা দুটো শেষ পেরেকটা ঠুকে দিলে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের ওপর। কফিন না-ই বা লিখলাম।
একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। মুনাওয়ার ফারুকি, ভারতের স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান। মাঝেমধ্যেই দেখি তাকে। মামলা-মোকদ্দমা, জেল-আদালত ঘুরে ফেলেছে এই অল্প বয়সেই৷ এখন সবই আছে তার। এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, এখনো ফ্লোরে বসেই খাই, চাইলেই ডাইনিং আনতে পারি। কিন্তু অভ্যাস-অতীত তো ফেলে দিতে পারব না।
ফিরি আহমেদাবাদে। ম্যাচ প্রেজেন্টেশনে গেছেন, অকপটে বলেছেন আমি চাষার ছেলে। আজ যে কয়টা বল বাউন্ডারির বাইরে গেছে সব কয়টা আমি তাঁদের উৎসর্গ করলাম। রুট ভুলে যায় না সবাই। মুনাওয়ারের মতো তিনিও বুঝিয়ে দিলেন, অতীতটাই সব লড়াইয়ের রসদ।
কেন বলবেন না? উত্তর প্রদেশের আলিগড়ের ফ্যামিলিটার ওপর ছিল লাখ পাঁচেক দেনা। গ্যাসের দোকানের কম্পাউন্ডে ছোট্ট দুইটা রুম। খাট, হাতেগোনা জীর্ণশীর্ণ আসবাব, ওপাশে একটা ছোট্ট টিভি। ৫ জনের সংসার৷ বাবা এলপিজি সিলিন্ডার ডেলিভারি দেন। ওতে সংসার চলে না।
ক্রিকেট অন্তপ্রান একটা ছেলে। পরিবারে খানিকটা স্বস্তি ফেরাতে বড় ভাই অন্য কাজে নিয়ে যান তাকে। এক কোচিং সেন্টারে ধোয়ামোছার কাজ। সেটা সইবার কথাও না, হলোও না। সেই বাইশ গজেই যার নিয়তি, ব্যাটই যার হয়ে কথা বলবে; তার হাতে ঝাড়ু আর ফ্লোর মোছার ন্যাকড়া তো মানায় না।
কালে কালে কত জল বইল যমুনায়। ভাগ্যদেবীও কিছুটা সুপ্রসন্ন হলেন। দিন ফিরল বলে। ফিরল অবশেষে। বেইজ প্রাইস বিশ লাখের চার গুণ হলো নিলামের টেবিলে দুই ফ্র্যাঞ্চাইজির কাড়াকাড়িতে। ভাই-বোনের বিয়ে, সেভিংস, বাড়ির জন্য মজুদ; মিলেমিশে দিন ফিরল।
আইপিএলের এই বিশাল হিস্ট্রিতে এমন অনেক গল্প আছে। অনেক চরিত্র আছে। জয়সওয়াল আজাদ ময়দানের বাইরে পানিপুরি বিক্রি করতেন, রবি বিষ্ণয়ের যোধপুরে কোনো ক্রিকেট ইনফ্রাসট্রাকচারই ছিল না। লোকাল কোচদের সাথে মিলে বানিয়েছিলেন একাডেমি, রাজস্থানের উত্তপ্ত বালিতে। মেহরানগড়ের ফোর্টে শ্যুট হয়েছিল ব্যাটম্যান, ডার্ক নাইটের এক কিস্তি। ক্রিশ্চিয়ান বেল মুক্তি পেয়েছিলেন সেই দূর্গ থেকে। রবিও আঁধার ফুঁড়ে বেরিয়েছেন সেভাবেই।
রিঙ্কু সিংয়ের গল্পটাও তো তাই। পারিবারিক-অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা তো ছিলই। এসবের বাইরেও আরো কিছু যুদ্ধ ছিল তার। এইতো গত আসরেই তাকে নিয়ে কত ট্রল টিপ্পনি। সৃজিত মুখার্জি বেশ তোরজোর করেই মজা লুটছিলেন। এবার সেই সৃজিতই লিখছেন, বাংলায় দুইটা সিংই আছে। অরিজিৎ সিং আর রিঙ্কু সিং।
বছরখানেক ধরেই একটা ট্রল পেইজ দেখি তার নামে। রিঙ্কু সুইং। আজ একবার ঘুরে আসুন। ভাইব বদলে গেছে আমুল। দুদিন আগেই শাহরুখ ড্রেসিংরুমে গিয়ে বলেছেন, রিংকু মেরা বাচ্চা। কঠিনতম দিন দেখে আসা রিংকু সেই কিং খানের সাথেই ক্যামেরা বন্দি হন পোজ মেরে৷
আগের আইপিএলে এমন একটা হাইস্ট প্রায় করেই ফেলেছিলেন। এভিন লুইসের অপার্থিব একটা ক্যাচে সেবার আর তীরে তরী ভেড়ানোও হয়নি জাদুর বৈঠা ঠেলে। আজ শেষ পাঁচ বলের জটিল সমীকরণ মিলে গেল, মিলিয়ে দিলেন।
সাড়ে পাঁচ ফুটের শরীরের ৩৬ ইঞ্চি ছাতির নিচে ৭২ ইঞ্চি কলিজাওয়ালা ছেলেটা পদে পদে অপেক্ষা করা কঠিন বাস্তবতার বাধা পেরিয়ে অবাস্তব, অপার্থিব ঢংয়ে মায়াঞ্জন এঁকে দিল ক্রিকেটের মাঠে। হাতে নিয়ে ব্যাটরুপী ম্যাজিক ওয়ান্ড। এক লহমায় নিয়ে গেল সেই দুরন্ত শৈশবের রাত দশটায়। যেখানে ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া ছেলেটা চোখ বুজে না ঘুমিয়েই স্বপ্ন দেখতো এভাবে ম্যাচ জেতাবে। ছয়ের পর ছয় মারবে।
জীবনের হাজারটা রঙ দেখে আসা রিঙ্কু সিং। ক্রিকেট লার্জার দ্যান লাইফ বলে বিশ্বাস করতে চাই না অনেকদিন। তবে আপনার মতো অনেকের বদৌলতেই মাঝেমধ্যে মনটা রায় দিতে চায়, ক্রিকেট বোধহয় লার্জার দ্যান লাইফ। নইলে কেন এত চর্চা আপনার অতীত নিয়ে?
আজ যদি শেষ বলটা কানেক্ট না হতো, তাও আপনি জিততেন। কলকাতা হারতো। তবে আপনিই জিততেন। এরচেয়ে বড় যুদ্ধটা তো জিতে এসেছেন আপনি। শেষের বলটা বাউন্ডারিতে পাঠানোর মতো মাপা সব শটে।
রিঙ্কু, আপনি থাকছেন স্যার।