ক্রিকেট মাঠে মায়াঞ্জন বুজি এভাবেই আঁকতে হয়! রিঙ্কু সিং যেভাবে করে দেখালেন। এক লহমায় বদলে ফেললেন নিজেকে। দৃশ্যপটে হয়ে উঠলেন নতুন চর্চার বিষয়।
গুজরাট টাইটান্সের বিপক্ষে কলকাতার সামনে শেষ ৫ বলে ২৮ রানের প্রায় ‘অসম্ভব’ হয়ে ওঠা সমীকরণ। গুজরাটের অধিনায়ক রশিদ খানের চোখ তখন আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জয়ের তৃপ্ততায় মাঠ ছাড়ার দিকে। কলকাতার ড্রেসিংরুমও তখন আরেকটা হতাশার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছিল। কিন্তু সকলকে বিস্ময়ে ভাসিয়ে, টানা ৫ বলে ৫ ছক্কা হাঁকিয়ে কলকাতাকে জয় এনে দিলেন রিঙ্কু সিং।
আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের সে রাতে রশিদ খান হ্যাটট্রিক করেছিলেন। তার আগে ব্যাট হাতে ফিফটি পেয়েছিলেন সাঁই সুদর্শন আর বিজয় শঙ্কর। তবে সবকিছুই ম্লান হয়ে যায় রিঙ্কু সিংয়ের ঐ অবিশ্বাস্য ইনিংসে।
রিঙ্কু সিংয়ের পাদপ্রতীপে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা সেখান থেকেই। তবে আলীগড়ের এ ক্রিকেটার যেন অন্য ধাতুতে গড়া। গুজরাটের বিপক্ষে অমন একটা ইনিংস খেলার পরের ম্যাচেই আবারো দেখালেন তাঁর ব্যাটিং তাণ্ডবের পুনরাবৃত্তি। পহেলা বৈশাখে ইডেনের মাটিতে হায়দ্রাবাদের বোলারদের উপর এ দিন যেন একটা বৈশাখী ঝড় বইয়ে দিলেন। আইপিএল ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো পেলেন ফিফটির দেখা। তবে আগের দিনের মতো ম্যাচটা আর জেতাতে পারলেন না।
অবশ্য তাতে কী! ২২৮ রানের রান পাহাড় গড়া হায়দ্রাবাদকে যে ম্যাচ শেষ হওয়া অবধি একটুও স্বস্তিতে রাখেননি এ ব্যাটার। এমন ম্যাচেও হায়দ্রাবাদকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে শেষ ওভার পর্যন্ত। কারণটা ঐ রিঙ্কু সিং। যার অপার্থিব ইনিংসে আগের ম্যাচে ভুক্তভোগী হয়েছিল গুজরাট টাইটান্স। তাই রিঙ্কু সিংকে নিয়ে হায়দ্রাবাদের বোলার ভয়ের আবহ ছিল ম্যাচের শেষ পর্যন্ত।
ব্রাত্য থেকে জাত্য- বলে একটা ব্যাপার আছে। রিঙ্কু সিংয়ের পথযাত্রাটা ঠিক এমনই। সেই ২০১৭ সালে প্রথম বারের মতো আইপিএলের মঞ্চে সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু গোটা আসরটাই সাইডবেঞ্চে কাটালেন এ ক্রিকেটার। পরের বছর ৮০ লাখ রূপিতে রিঙ্কুকে দলে ভেড়াল কলকাতা নাইট রাইডার্স। আগের চেয়ে ৪ গুণ দামে বিক্রি হলেন, কিন্তু নিজের ফর্মটা আর দেখাতে পারলেন কই!
সে আসরে ৪ ম্যাচে নিজের নামের পাশে মোটে যোগ করতে পারলেন ২৯ রান। পরের আসরেও একই চিত্র। ৩ ইনিংসে ৩৭ রান। টানা দুই আসরের ব্যর্থতায় পরের আসরে সুযোগ পেলেন মাত্র ১ টি ম্যাচে। এরপর আর সুযোগই পেলেন না। ২০২১ আইপিএলেও থাকলেন ব্রাত্য হয়ে।
কী মনে করে, ২০২২ আইপিএলে আবারো রিঙ্কুকে দলে ভেড়াল কলকাতা। অবশ্য আগের চেয়ে একটু কমমূল্যে, ৫৫ লাখ রূপিতে। তবে কলকাতার এই কমমূল্যে কেনা ক্রিকেটারই ২০২২ আইপিএলে কিছুটা সম্ভাবনার গল্প লিখলেন।
পুরো আসরে ১৭৮ রান করলেন। যার মধ্যে খেললেন দুটি চল্লিশোর্ধ্ব ইনিংস। খুব দারুণ কিছু না। তবে লখনৌর বিপক্ষে দুর্দান্ত একটা ইনিংস খেলে প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচটা কলকাতাকে বলতে গেলে একাই জিতিয়ে দিয়েছিলেন। তবে এভিন লুইসের দুর্দান্ত এক ক্যাচে শেষ পর্যন্ত সেদিন জয় এনে দিতে পারেননি রিঙ্কু। তবে সম্ভাবনার একটা বীজ বপন করেছিলেন ঐ দিনেই। একটা ইঙ্গিত মিলেছিলে সেদিনই, এই ছেলের দারুণ সক্ষমতা আছে।
সেই সক্ষমতার পরিস্ফূরণ হলো এবারের আসরে। শুরুর ম্যাচে মাত্র ৪ করলেন। কিন্তু পরের তিন ম্যাচের তিনটাতেই ৪০+ ইনিংস, যার মধ্যে দুই ইনিংসেই আবার অপরাজিত। আইপিএল ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ৪০৭ করা রিঙ্কু এই চার ম্যাচেই করলেন ১৫৬ রান। গড় ৭৮! আর স্ট্রাইকরেট টা ১৭৫.২৮, যা এবারের আইপিএলে ১৫০+ রান করা ব্যাটারদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
২০১৭ তে আইপিএল মঞ্চে পা রাখা রিঙ্কু সিং নিজের খেল টা অবশেষে দেখাতে শুরু করলেন ২০২৩ এ এসে। ঘুরে দাঁড়ানো কিংবা নিজেকে প্রমাণের সংজ্ঞাটা বোধহয় এমনই হওয়া উচিৎ। পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে এক সময় কাজ করা ছেলেটাকে নিয়ে এখন বন্দনা হয় গ্যালারির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। শাহরুখ খান, যাকে বলিউডের কিং বলেই সবাই জানে সেই তিনি রিঙ্কুতে অভিভূত হয়ে পোস্ট দেন, ‘দ্য কিং, রিঙ্কু কিং’। শাহরুখকন্যা সুহানার উচ্ছাসটাও কম না। কলকাতার নায়ক হিসেবেই যার কাছ থেকে স্বীকৃতি মিলে গেছে।
জীবন সংগ্রামে হাজারটা রঙ দেখে আসা রিঙ্কু সিং এমন রঙিন অধ্যায়টা নিশ্চিতভাবেই উপভোগ করছেন। আলীগড়ের অতি সাধারণ পরিবার থেকে বাইশ গজে আবর্তন, এরপর আইপিএলের মঞ্চে নিজেকে চেনানো। এই ধারাবাহিকতায় এবার নিশ্চয়ই দূর স্বপ্নে চোখ রাখছেন তিনি। কোনো কিছুই যে অসাধ্য, অসম্ভব নয়, তা তো পৃথিবী নতুন ভাবে জেনেছে এই রিঙ্কুর কল্যাণেই। রিঙ্কুর পথযাত্রা তাই এবার আর শ্লথ না হোক, দুরন্ত গতিতে ছুটে চলুক তাঁর ব্যাট নাম তরবারির আগ্রাসন।